খবরের বিস্তারিত...


শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ক্ষেত্রে আর কালক্ষেপণ নয় ——-এম ইব্রাহীম আখতারী

দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা খুবই সংকটকাল অতিক্রম করছে। ১৫ মাস যাবত দেশের প্রায় সবধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। ফলে অনেকেরই শিক্ষা জীবনে নেমে এসেছে ঘোর অমানিশা। তাসের ঘরের ন্যায় ভেঙ্গে পড়েছে অনেক শিক্ষার্থীর স্বপ্নসৌধ। প্রকৃতির রুদ্ররোষ এর অশুভ শিকারে পরিণত হয়ে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থায় আজ সংকটাপন্ন। উল্লেখ্য যে, ২০১৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ১৮ মাস পূর্বে কোভিড-১৯ নভেল করোনা ভাইরাস নামক অতিমারির সাথে পরিচয় ঘটে বিশ্ববাসীর। প্রারম্ভিক পর্যায়ে যেটির অস্থিত্ব দৃশ্যমান হয় চীনের উহান শহরে। চীন এর পক্ষ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ ইং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে প্রাণঘাতি এ মহামারির সত্যতা নিশ্চিত করা হয়। এ অদৃশ্য ভাইরাস চীনের মধ্যে ব্যাপক তাণ্ডব অব্যাহত রাখার পাশাপাশি ক্রমাগতভাবে বিস্তৃত হতে থাকে আশপাশের দেশসমূহে। অতঃপর নাতিদীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এটির সংক্রমন। এবং ক্রমান্বয়ে প্রায় ২১৫ টিরও অধিক রাষ্ট্র এ ভাইরাসের অশুভ শিকারে পরিণত হয়। যেটির ভয়াবহতা প্রায় সবকটি দেশকেই লণ্ডভণ্ড করে দেয়। ভেঙ্গে পড়ে বিশ্ব যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে স্বাভাবিক নাগরিক জীবনযাত্রা। মুখ থুবড়ে পড়ে বিশ্ব অর্থনীতি। যেটির বিষাক্ত ছোবলে বিশ্ব হারায় অসংখ্য কীর্তিমান-খ্যাতিমান সোনার মানুষ। পাল্টে যায় বিশ্বচিত্র। অজানা-অচেনা এক রূপ ধারন করে তাবৎ দুনিয়া। যে ধারাবাহিকতায় এ অদৃশ্য ভাইরাসের কবল থেকে বাদ যায়নি প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশও। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম করোনা সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ ২০২০ ইং। তখন থেকেই সংক্রমন ঠেকাতে রাষ্ট্রীয়ভাবে নেয়া হয় বিবিধ উদ্যোগ-আয়োজন। এমনকি এতদসংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগীদের জন্য সরকার প্রায় ১লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ প্রনোদনা বাস্তবায়ন করে। এ অদৃশ্য ভাইরাসের কোন প্রতিষেধক না থাকায় লকডাউনকেই অন্যতম বিকল্প হিসেবে বেছে নেয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ।এক্ষেত্রে বাংলাদেশও এদের অনুসৃত পথেই হাটতে থাকে। অর্থাৎ লকডাউনের দিকেই ধাবিত হয় বাংলাদেশ। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, দীর্ঘমেয়াদী লকডাউনের কারণে বিশ্বব্যাপী শিক্ষা ব্যবস্থায়ও ব্যাপক বিরূপ প্রভাব পড়ে। যৎকারণে বিশ্বের অপরাপর দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও সবধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। যার নেতিবাচক পরিণতিতে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক মহলে নেমে আসে চরম হতাশা। এহেন কঠিন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ তথা শিক্ষাধারা চলমান রাখতে ভার্চুয়াল পাঠক্রমের উপর জোর দেয় বাংলাদেশ সহ বিশ্বের প্রায় সকল দেশ। শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় অব্যাহত থাকে অনলাইন পদ্ধতির বিভিন্ন প্রয়াস। অনস্বীকার্য বাস্তবতা হলো, এক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের দেশ সমূহকে আল্ট্রা-মডার্ণ প্রযুক্তির সুবাদে ভার্চুয়াল শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় তেমন বেগ পেতে না হলেও বাংলাদেশে তা কোনভাবেই নির্বিঘ্ন হয়না। যেহেতু ভার্চুয়াল ক্লাস, পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট, ওয়েবিনার ইত্যাকার বিষয়াদি এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে মোটেও পরিচিত নয়। সেহেতু এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে বিবিধ অবাঞ্ছিত বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কারণ প্রযুক্তিগতভাবে বাংলাদেশকে কোনভাবেই বিশ্বের অপরাপর দেশ থেকে অপেক্ষাকৃত অগ্রগামী ভাবা যায় না। যেথায় রয়েছে বহুমাত্রিক সীমাবদ্ধতা। যেমন-এক্ষেত্রে রয়েছে,ওয়াইফাই ও ব্রডব্যান্ড সুবিধা সম্পন্ন প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সংযোগের অপ্রতুলতা, মফস্বল এলাকায় হাইরেঞ্জ নেটওয়ার্ক এর অনুপস্থিতি, অধিকাংশেরই অনলাইন উপকরণ তথা এন্ড্রয়েড মোবাইল সেট, ল্যাপটপ, পি সি ইত্যাদি ক্রয়ের অক্ষমতা। এছাড়াও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা কার্যক্রমের প্রাক অভিজ্ঞতা না থাকায় এক্ষেত্রে শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনেকেই থাকে দ্বিধা-সংশয়গ্রস্ত। সত্যিকার অর্থে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের চিন্তা-চেতনার বহিঃপ্রকাশ হওয়ার মূল কেন্দ্রস্থল হচ্ছে শ্রেণিকক্ষ।যদ্দরুন অনলাইন পাঠক্রমে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সাবলীলতা দৃশ্যমান হয়না। লেখাপড়ার প্রতি শিক্ষার্থীদের ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে অনাগ্রহ ও উদাসীনতা। এবং ধীরে ধীরে লেখাপড়া বিমুখ হয়ে পড়ছে অনেক শিক্ষার্থী। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, অনলাইন পদ্ধতি নির্ভর শিক্ষা কার্যক্রম সকল দেশের জন্য ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনতে সক্ষম নয়। তাই অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমকে প্রচলিত শিক্ষার বিকল্প ভাবা কোনভাবেই সমীচীন নয় বলে মনে করি। এছাড়াও অনির্দিষ্টকালের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে বহুমাত্রিক সমস্যায় নিপতিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। যেমন-অনেকেই শিক্ষা জীবনের সমাপ্তিলগ্নে এসে বহুল কাঙ্খিত সনদ অর্জন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যা অনেকটা তীরের নিকটে এসে নৌকা ডুবিয়ে যাওয়ার মতোই। অনেকেই শিক্ষাবর্ষ শেষ না হওয়ার কারণে উচ্চ শিক্ষার্জনে ক্রমশঃ আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। আবার দারিদ্রক্লিষ্টতার কারণে অনেকেই লেখাপড়া ত্যাগে বাধ্য হচ্ছে। ইতোমধ্যে অনেকেই লেখাপড়া ত্যাগ করে গ্যারেজ, ওয়ার্কসপ, বাস-টেম্পুর হেলপার, হোটেল-রেস্তোঁরার বিয়ারা, কুলি-মজুর তথা রিক্সা চালনা কাজে জড়িয়ে পড়েছে। আবার অনেকেই ক্রমাগত বিবিধ অনৈতিক কাজে জড়িয়ে গিয়ে অন্ধকার জগতের বাসিন্দায় পরিণত হচ্ছে। যাইহোক, এখানে এটি উল্লেখ না করলেই নয় যে, বাংলাদেশে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি ব্যক্তি মালিকানাধীন অসংখ্য কিন্ডারগার্টেন স্কুলের অস্তিত্ব বিদ্যমান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান দেশে মানসম্মত শিক্ষার উন্নয়নে নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে এবং জাতীয় জীবনে একটি মেধাবী প্রজন্ম সৃষ্টিতে অহর্নিশ অবদান রেখে চলেছে। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়-দেশে ব্যক্তি মালিকানাধীন উক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। যেখানে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যাা প্রায় ৫০ লাখ, শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত রয়েছে প্রায় ২০ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। দূঃখজনক হলেও সত্য যে, দীর্ঘ টানা ১৮ মাস যাবত বন্ধ থাকায় লাটে উঠেছে এসব প্রতিষ্ঠানসমূহ। প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে সম্পূর্ণ বেকার হয়ে পড়েছে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক-শিক্ষিকা ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। উপার্জনের বিকল্প কোন উৎস না থাকায় এরা একেবারেই নিঃস্ব ও রিক্তহস্ত। ফলে এরা পরিবার-পরিজন নিয়ে এখন দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। উল্লেখ্য যে, চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে এ অদৃশ্য ভাইরাসকে সঙ্গী করেই বসবাস করতে হবে বিশ্ববাসীকে। প্রত্যেকেই ভ্যাকসিনেসনের আওতায় আসলেই সংক্রমনমুক্ত এমনটি নয়। ভ্যাকসিন গ্রহণের পরও সকলেরই পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যবিধির অনুসরণ বাঞ্ছনীয় বলে মত ব্যক্ত করেন চিকিৎসকরা। তাই বলে মানুষের জীবন-জীবিকা থেমে থাকবে এমনটি হতে পারে না। মানুষের মধ্যে জেঁকে বসা শঙ্কা, হতাশা ও সর্বপ্রকার অবাঞ্ছিত আতংক-ভীতি দূর করে দৃঢ় মনোবল ও সাহসিকতার সঙ্গে চলমান পরিস্থিতি সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করতে হবে। অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই যে,এদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি কোন অবস্থাতেই উন্নত দেশের সমপর্যায়ের নয়। বৈদেশিক রেমিট্যান্স, গার্মেন্টস শিল্প এসব খাতসমূহের উপরেই অনেকাংশ নির্ভরশীল বাংলাদেশের অর্থনীতি। তাই অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে এহেন প্রতিকুল পরিস্থিতিতেও এসব চলমান রাখতে হচ্ছে। জীবন-জীবিকার জন্য চালু রাখতে হচ্ছে গণ পরিবহন অফিস-আদালত, ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্প কারখানা, দোকানপাট, আমদানি-রপ্তানী ইত্যাদি। সুতরাং যে রীতি ও পদ্ধতিতে এসব চলমান থাকবে ঠিক অনুরূপভাবে সবধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহও চালু রাখা আবশ্যক বলে মনে করি। এক্ষেত্রে আগামী ১৩জুন ২০২১ইং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার সরকারি ঘোষনা আশাব্যাঞ্জক। সরকারি এ ঘোষনার যাতে কোন হেরফের না হয় তজ্জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সর্বোচ্চ সতর্ক দৃষ্টি থাকা বাঞ্ছনীয়। কেননা করোনায় শিক্ষা ব্যবস্থার যে অপরিসীম ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণ হবার নয়। এটি বিস্মৃত হবার নয় য়ে, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা ব্যবস্থার অগ্রগতি ও সাফল্যই দেশের সমৃদ্ধির সোপান হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। তাই শিক্ষা ব্যবস্থার গতিশীলতার ক্ষেত্রে কোনরূপ ব্যত্যয় ঘটলে জাতীয় লক্ষ্যার্জন সুদুর পরাহতই হয়ে থাকবে। অতএব, আর কোনপ্রকার কালক্ষেপণ কিংবা দীর্ঘসূত্রিতা নয়, অবিলম্বে সরকারকে জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ খুলে দেয়ার কার্যকর পদক্ষেপে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় এযাবতকালের সর্বপ্রকার অর্জনই বৃথা হয়ে যাওয়ার সমূহ আশংকা রয়েছে।

লেখকঃ অধ্যক্ষ এম ইব্রাহীম আখতারী
প্রাবন্ধিক ও রাজনীতিবিদ

সূত্রঃ ৩১ মে ২০২১ইং দৈনিক পূর্বকোণ।

Comments

comments