খবরের বিস্তারিত...


ফিলিস্তিনে ইসরাইলি বর্বরতাঃ বিশ্ব বিবেকের জাগরণ আবশ্যক—– এম ইব্রাহীম আখতারী

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় টানা ১১দিন ভয়াবহ বিমান হামলার পর অবশেষে যুদ্ধ বিরতির ঘোষনা দিয়েছে ইসরাইল। দেশটির নিরাপত্তা মন্ত্রীসভা বৃহস্পতিবার রাত ২টার দিকে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে যুদ্ধ বিরতিতে অনুমতি দিয়েছে। ইসরাইল ও হামাসের এই সমঝোতাকে শান্তি প্রতিষ্ঠার বড় সুযোগ বলে মনে করছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ বিশ্ব নেতারা। এ ঘটনাকে ফিলিস্তিনিদের ঐতিহাসিক বিজয় বলে দাবি করেছে হামাস।

গণমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী গত ১১দিনে ৬৫জন শিশুসহ ২৮৫জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে হানাদার ইসরায়েলি বাহিনী। ধ্বংস করা হয়েছে সরকারী-বেসরকারী অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। বাদ যায়নি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও। যুদ্ধ বিরতির পরও তারা জেরুজালেমে হামলা চালিয়েছে। অত্যন্ত দূঃখজনক হলেও সত্য যে, ফিলিস্তিনে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলেও নির্লিপ্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। বোবা ও বধিরের ভূমিকায় জাতিসংঘ। নিরব দর্শক আরবলীগ এবং ওআইসি। দায়সারা গোছের নিন্দা-বিবৃতিতেই সীমাবদ্ধ এদের দায়িত্ব। যা বিশ্ব মুসলমানদের অবাঞ্ছিত হতাশায় নিপতিত করছে প্রতিনিয়ত। উল্লেখ্য, বিশ্ব অঙ্গনে ফিলিস্তিনিরা হচ্ছে ভাগ্যবিড়ম্বিত একটি জাতি। যারা ছিল অটোমান সাম্রাজ্যেের অধীনস্থ। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, ভূমিজসন্তান হয়েও ফিলিস্তিনিরা শতবর্ষ কাল ধরে ভূঁইফোড় ইহুদী দখলদার বাহিনীর নিকট মার খাচ্ছে প্রতিনিয়ত। যেথায় রক্ত ঝরছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। অথচ আরব মুসলমানরাই ছিল অবিভক্ত ফিলিস্তিনের সংখ্যাগরিষ্ট জনগোষ্ঠী। ১৯ শতকের শেষদিকে ইহুদীদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় আরব ভূখণ্ডের উপর। গড়ে উঠে জায়ানবাদী আন্দোলন। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সরকার বেলফোর ঘোষণায় ফিলিস্তিনে ‘ইহুদিদের একটি জাতীয় বাসস্থান’ প্রতিষ্ঠায় সমর্থন জানায়। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইহুদি নেতারা ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণা দেন। পরদিন আরব দেশসমূহ ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধ লেগে যায়। এতে আরবরা পরাজিত হয়। যৎকারণে প্রস্তাবিত আরব রাষ্ট্রের একটা বৃহৎ অংশ দখল করে ইসরায়েল। ফলশ্রুতিতে অনাকাঙ্খিতভাবে সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনি নিজ ভূমিতেই শরণার্থী হয়। অতঃপর আরব-ইসরায়েলের মধ্যে ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালে আরও তিনটি যুদ্ধ হয়। এতেও ফিলিস্তিনের কোনরূপ ইতিবাচক কিনারা হয়নি। বরং ক্রমাগতভাবে মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া ইসরায়েলের একগুঁয়েমি ও নৃশংসতায় ফিলিস্তিনে রক্তক্ষয়ী সংঘাত অব্যাহত থাকে। শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এযাবতকাল বহুমাত্রিক উদ্যোগ নেয়া হলেও সফলতা অধরাই থেকে গেছে। উপরন্তু প্রজন্ম পরম্পরায় সেখানে নতুন মাত্রায় সংঘাত-সহিংসতা জন্ম নিয়েছে। ১৯৮৭ সালে দখলদারিত্ব মুক্ত করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের প্রত্যয়ে গঠিত হয় হামাস। এ সংগঠনটিকে জঙ্গি তকমা দিয়ে স্বীকৃতি দেয় না ইসরায়েল। অতঃপর ২০০৭ সালের আগস্টে ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে ফিলিস্তিনের দুই অংশ পশ্চিম তীর ও গাজা চলে যায় দুটি দলের নিয়ন্ত্রণে। তখন থেকে মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বে ফাতাহ পশ্চিম তীরে ও হামাসের খালেদ মেশালের নেতৃত্বে গাজা শাসন করে আসছে। এটি অনস্বীকার্য যে, পশ্চিমা প্রভুদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে ইসরাইলি সেনাবাহিনী বিপুল মার্কিন তহবিল এর বিনিময়ে আরবের বুকে ইসরায়েলকে সাম্রাজ্যবাদের পাহারাদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। ইঙ্গ-মার্কিনীদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদদে যে কোন মূল্যে এরা ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদে মরিয়া। এদের এহেন প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রতিবাদ জানালেও মিত্রশক্তিরা তা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার হীন প্রচেষ্টা চালায়। ইসরায়েল পবিত্র রমজান মাসে আল-আকসা মসজিদে যেতে মুসলমানদের বাধা সৃষ্টি করছে, জায়নবাদী ফ্যাসিস্টরা তথায় আগুন দিচ্ছে, অথচ প্রতিবাদ জানালে ইঙ্গ-মার্কিনীদের কর্তৃক তাদের দেয়া হয় সন্ত্রাসী তকমা। আর নারী-শিশুসহ নিরীহ মানুষ হত্যার জবাবে গাজা থেকে রকেট ছোড়া হলে শহরের ওপর লাগাতার বোমাবর্ষণ করে বলতে থাকে, এটি তাদের আত্মরক্ষার অধিকার। কি আজিব কাণ্ড! ফিলিস্তিনিদের জমি দখল করে অবৈধ বসতি স্থাপন অব্যাহত থাকবে, জেরুজালেম থেকে সব ফিলিস্তিনিকে জোরপূর্বক তাড়িয়ে দেয়া হবে, ফিলিস্তিনের বৈধ রাজধানীকে নিজেদের রাজধানী বলে ঘোষণা করবে; তথাপিও ফিলিস্তিনিদের আত্মরক্ষার অধিকার থাকতে পারবে না এ কেমন কথা। সত্যিকার অর্থে যা বর্বর ইহুদী-খৃষ্টানদের চিরায়ত মুসলিম বিদ্বেষী মনোবৃত্তি বৈ আর কিছুই নয়। বাস্তবিকপক্ষে-জেরুজালেমের পুরনো শহরে অবস্থিত মসজিদুল আকসা বা বাইতুল মুকাদ্দাস ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ। এটির সাথে একই প্রাঙ্গণে কুব্বাত আস সাখরা, কুব্বাত আস সিলসিলা ও কুব্বাত আন নবী নামক স্থাপনাগুলো অবস্থিত। স্থাপনাগুলো সহ এই পুরো স্থানটিকে হারাম আল শরিফ বলা হয়। প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (দ.) মিরাজের রাতে মসজিদুল হারাম থেকে আল-আকসা মসজিদে এসেছিলেন এবং এখান থেকে তিনি উর্ধাকাশের দিকে যাত্রা করেছিলেন। সম্পূর্ণ উপাসনার স্থানটিই হযরত সোলায়মান (আ.) নির্মাণ করেছিলেন। এটি নির্মিত হওয়ার পর থেকে ঈসা (আঃ) সহ অনেক নবী কর্তৃক এটি আল্লাহর উপাসনার স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই পুরো স্থানটিই মুসলিমদের প্রথম কিবলা। অতএব মুসলিম উম্মাহর এ কীর্তিমান তীর্থস্থানটি হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে না। আল্লাহ না করুক এক্ষেত্রে যদি কোনরূপ ব্যত্যয় ঘটে, তাহলে আরবভূমিতে অবস্থিত পবিত্র মক্কা-মদিনার দিকে এ অপশক্তি আঙ্গুল তুললে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। তাই কারও পক্ষে আর অন্ধ-বধির হয়ে বসে থাকা কোনভাবেই সমীচীন হবে না। ফিলিস্তিন মানবিক বিপর্যয়ের শিকার। সুতরাং এ মূহুর্তে বিশ্ব বিবেকের জাগরণ আবশ্যক। এখন থেকেই বিশ্ব মুসলমানদের রক্তচোষা ইসরাইলের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর নৃশংসতা বন্ধ করতে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অধিকতর চাপ সৃষ্টি করা ফরজ হয়ে পড়েছে। সর্বত্র ইসরাইলী পণ্য বর্জনসহ এদের বয়কট এর মাধ্যমে প্রতিকী প্রতিবাদ অব্যাহত রাখতে হবে। ওআইসি, আরবলীগসহ সকল মুসলিম দেশকে ইসরাইলী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে সোচ্চার ভূমিকায় এগিয়ে আসতে হবে। সর্বোপরি আগ্রাসন বন্ধে জাতিসংঘকে দৃশ্যমান সক্রিয়তায় এগিয়ে আসার জন্য সকল মুসলিম রাষ্ট্রসমূহকে কার্যকর ও জোরালো তৎপরতার মাধ্যমে বাধ্য করতে হবে।

লেখকঃ অধ্যক্ষ এম ইব্রাহীম আখতারী
প্রাবন্ধিক ও রাজনীতিবিদ

সূত্রঃ ২৩ মে ২০২১ইং, দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকা।

[related_post themes="flat" id="1610"]