ইসলামে পুষ্টিকর খাবারের গুরুত্ব — অধ্যাপক মুহাম্মদ নুর হোসাইন।
ইসলাম শুধু কিছু নীতিবাক্য সম্বলিত ধর্ম নয়; বরং মানুষের জীবনঘনিষ্ট সব বিষয়ের বর্ণনা সম্বলিত জীবনবিধান। তাই কল্যাণকর ও অকল্যাণকর খাবার ও পানীয় বিষয়ক আলোচনাও এতে স্থান পেয়েছে। স্বাস্থ্যসম্মত, পুষ্টিকর, ও রুচিসম্মত খাবার কোনগুলো- তার সবিস্তার বর্ণনা রয়েছে পবিত্র কুরআন-হাদিসে। আল্লাহর নবি (দ.) সুস্থতাকে বড় নিয়ামত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং সবল হওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেন, “দুর্বল মুমিন অপেক্ষা সবল মুমিন উত্তম” (মুসলিম: ২৬৬৪)। তিনি আরো বলেন, যে ব্যক্তি দিনের সূচনা করল প্রশান্ত মনে, সুস্থ দেহে এবং তার নিকট সেই দিনের খাবার মওজুদ আছে সে যেন দুনিয়া জয় করল” (তিরমিযি: ২৩৪৬)। তাঁর খাদ্যাভ্যাস পর্যালোচনা করলেও প্রমাণিত হয় যে, তিনি হালাল ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতেন এবং সাহাবিদেরকে সেগুলো গ্রহণের পরামর্শ দিতেন। কারণ, শারীরিক সুস্থতা ও অসুস্থতা অনেকটা নির্ভর করে খাদ্যাভ্যাসের ওপর। শরীর সুস্থ মানে মন সুস্থ। আর ইবাদত করতে হয় সুস্থ মনে, একাগ্রচিত্তে। তাই শরীরের সুস্থতার জন্য স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা জরুরি। পাশাপাশি অবৈধ, অস্বাস্থ্যকর ও একান্ত মুখরুচক খাবার বর্জন করা আবশ্যক। পবিত্র কুরআনে প্রায় বিশটি আয়াতে “তাইয়িব” খাবার গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। শব্দটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়েছে উন্নত, নির্ভেজাল, জীবানুমুক্ত, স্বাস্থ্যকর, রুচিসম্মত ও পুষ্টিকর খাবারের অর্থে। যেমন ঊর্বর ভূমিকে “তাইয়িব” নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, “আর প্রতিপালকের ইচ্ছায় ঊর্বর ভূমিতে প্রচুর ফসল উৎপন্ন হয়” (সূরা আ‘রাফ: ৫৮)। আল্লাহ তায়ালা বার বার হালাল ও উন্নত খাবার গ্রহণের তাগিদ করেছেন। তিনি বলেন, “আমি তোমাদেরকে জীবিকা হিসেবে যা কিছু দিয়েছি সেগুলোর মধ্যে উন্নতগুলো ভক্ষণ কর” (সূরা বাকারা: ১৭২)। আরো বলা হয়েছে, “হে মানব, ভূমিতে উৎপন্ন খাবার থেকে হালাল ও উন্নতটি আহার কর” (সূরা বাকারা: ১৬৮)।
পবিত্র কুরআনে খেজুর, জলপাই, ডুমুর, আঙ্গুর, আনার, দুধ, মধু ইত্যাদির নাম পাওয়া যায়। এ ছাড়া সাধারণ ফলমূল, সবজি ও আমিষ জাতীয় খাবারের কথাও উল্লেখ আছে। আল-কুরআনের ৯৫ তম সূরার নাম “ত্বীন”, যাতে ডুমুর ও জলপাইকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আরেকটি সূরার নাম হলো “আন্নাহ্ল” বা মৌমাছি। মৌমাছির গুরুত্ব মধুর কারণে। উক্ত সূরাতে মধুর উপকারিতার কথা এসেছে। এতে খেজুর, আঙ্গুর, দুধের উপকারিতাও উল্লেখ হয়েছে। বলা হয়েছে, “মৌমাছির উদর থেকে নিঃসৃত হয় বর্ণিল পানীয়। এতে মানবের জন্য রয়েছে নিরাময়। জ্ঞানীদের জন্য এর মধ্যেও রয়েছে উজ্জ্বল নিদর্শন” (সূরা আন্লাহ্ল: ৬৯)। এভাবে সূরা “আর-রহমান”-এ ফল, খেজুর ও আনারকে জান্নাতি খাবার বলা হয়েছে। এক হাদিসে মাছের কলিজাকেও জান্নাতিদের প্রথম খাবার বলা হয়েছে। উল্লেখিত খাবারগুলোর বহুবিধ উপকারিতা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। অতএব পবিত্র কুরআনে যে-সব খাবার ও পানীয় গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে- সবগুলোই পুষ্টিকর। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা পুষ্টিকর খাবারের তাগিদ দিয়েছেন। মধুর উপকারিতা বর্ণনায় চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা পঞ্চমুখ। কারণ, মৌমাছি দিনে অন্তত ১২ বার ভ্রমণ করে ৪০০ প্রকারের ফলের রেণু থেকে মধু আহরণ করে। মধুতে ভিটামিন বি-১ থেকে বি-৬, ভিটামিন সি, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম, আইরন, সোডিয়াম রয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (দ.)-এর খাদ্যাভ্যাস বিষয়ক হাদিসগুলো দ্বারা প্রমাণিত যে, তিনি কম খেতেন; কিন্তু তিনি যা খেতেন সেগুলো ছিল পবিত্র, উন্নত, স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর। তিনি পান করতেন বিশুদ্ধ পানি। বর্জন করতেন অবৈধ, অপবিত্র ও অস্বাস্থ্যকর খাবার। খাওয়ার আগে-পরে তিনি হাত ধুয়ে নিতেন। মেঝেতে বসে ডান হাতের তিন আঙ্গুলে খেতেন। অতি গরম বা শীতল খাবার ও পানীয় এড়িয়ে চলতেন। প্লেট চেটে খেতেন। যা খেতেন, সেগুলো সম্পর্কে অভিযোগ করতেন না। খাবারের পরিমাণ সম্পর্কে তাঁর উক্তি হলো, “মানুষ নিজের পেট অপেক্ষা অধিক নিকৃষ্ট পাত্র পূরণ করে না। আদম সন্তানের জন্য তার প্রয়োজনীয় শক্তি অর্জনের জন্য কয়েক মুঠো খাবার যথেষ্ট। যদি তাকে পেট পূর্ণ করতেই হয় তাহলে সে যেন পেটের এক-তৃতীয়াংশ খাবারের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ পানের জন্য এবং অবশিষ্ট এক-তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য খালি রাখে” (তিরমিযি: ২৩০২)। পবিত্র কুরআনে যে-সব খাবারের নাম সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ হয়েছে সেগুলো ছিল তাঁর পছন্দের খাবার। তিনি এগুলোর উপকারিতাও বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, “তোমরা যায়তুনের তেল খাও এবং ব্যবহার কর। কেননা, এটি কল্যাণকর বৃক্ষ হতে তৈরি (তিরমিযি: ১৮৫২)। তিনি খেজুরকে উপকারী ফল ঘোষণা দিয়ে এটা দিয়ে ইফতার করতে বলেছেন (আবু দাউদ: ২৩৫৬)। আজওয়া খেজুর সম্পর্কে তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি প্রত্যেক দিন সকালে সাতটি আজওয়া খেজুর খাবে সেদিন বিষ বা যা যাদু তার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না (বুখারি: ৫৪৪৫)। মধুর মধ্যে আরোগ্য আছে বলেও ছহিহ বুখারির ৬৫৮০ নং হাদিসে উল্লেখ হয়েছে। জনৈক ব্যক্তি তার ভাইয়ের পেটের সমস্যার কথা নিয়ে তাঁর নিকট আসলে তিনি মধু খাওয়ানোর পরামর্শ দেন। উক্ত সমস্যা নিয়ে চতুর্থ বার আসার পরও তিনি মধু খাওয়ানোর পরামর্শ দেন। এবার এসে লোকটি খবর দিল যে, তার ভাই সুস্থ হয়েছেন (বুখারি: ৫৬৮৪)। তিনি কালিজিরাকেও অত্যাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। মিষ্টি ও সির্কাও তাঁর পছন্দের খাবারের মধ্যে ছিল।
জলপাই এর তেল কিডনি সমস্যার সমাধানে বেশ উপকারী বলে গবেষণায় প্রমাণিত। ডুমুর তন্তুযুক্ত ফল। এটি স্তন ক্যানসারের প্রতিরোধক। মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া ৫১৮২৩ জন মহিলার ওপর ৮.৩ বছর গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে যে, যারা তন্তুযুক্ত ফল খায় তাদের স্তন ক্যানসারের সম্ভাবনা ৩৪% কম। খেজুরে প্রচুর ভিটামিন আছে। এটি বদহজম, কোষ্টকাঠিন্য, প্রদাহ প্রতিরোধ করতে সহায়ক। দুধের উপকারিতা সর্বজন বিধিত। মোদ্দাকথা হলো, পবিত্র কুরআন-হাদিসে যে-সব খাবার ও পানীয়ের কথা বলা হয়েছে সেগুলো স্বাস্থ্যসম্মত, পুষ্টিকর এবং রোগ প্রতিরোধক। তাই পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা আল্লাহর বিধান এবং তাঁর নবি (দ.)-এর সুন্নাহ। খাদ্যাভ্যাসের ক্ষেত্রেও পবিত্র কুরআন-সুন্নাহর অনুসরণ জরুরি। তবে আরব দেশে উৎপন্ন খাবার গ্রহণ আবশ্যক নয়; বরং খাবারটি হালাল, স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিকর কিনা- সেটিই বিবেচ্য। কারণ, আরবের সব খাদ্য প্রত্যেক দেশে পাওয়া যাবে না। পাওয়া গেলেও আমদানিনির্ভর হওয়ার কারণে অপেক্ষাকৃত দাম বেশি হবে। তাই প্রত্যেক দেশের মানুষ সে-দেশের স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করাটাই উল্লিখিত আয়াত ও হাদিসের মর্মকথা। এটাও একটা আল্লাহ তায়ালার কুদরত যে, যে-দেশে যে-ফল ও শস্য উৎপন্ন হয় সে-দেশের মানুষের শরীরের জন্য সেটিই যুৎসই। বাংলাদেশের আম-জাম-কাঁঠাল-লিচু-কলা-পেয়ারা-আমলকি-জলপাই-বড়ই ইত্যাদিতে প্রচুর পুষ্টি রয়েছে। দেশীয় এ-সব ফল ও শাকসাবজি খাওয়া মানে আল্লাহর নবি (দ.)-এর সুন্নাহ বাস্তায়ন করা। কারণ, তিনি স্বদেশীয় পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতেন।
পুষ্টির অভাবে বাংলাদেশের মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়, বিশেষত গর্ভবতী মা ও শিশুর জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। শিশুকে পূর্ণ দুবছর দুধ না দেয়াও পুষ্টিহীনতার বড় কারণ। অথচ শিশুর জন্য মায়ের দুধের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোন খাবার পৃথিবীতে নেই। এটা শিশুর অধিকারও বটে। শিশুর সুস্থ ও সবল হয়ে বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে মায়ের দুধের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। কেউ যদি শিশুকে ইচ্ছাকৃতভাবে দুবছর দুধ না দেয় তাহলে সে দুগ্ধদানের দায়িত্ব পূর্ণ করল না। পাশাপাশি প্রত্যেক মা যেন পূর্ণ দুবছর শিশুকে দুগ্ধদান করতে পারেন সে-জন্য বাবাকে মায়ের যথাযথ খোরপোষের ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে পবিত্র কুরআনে। অর্থাৎ যদ্দুর সম্ভব, মায়ের জন্য পুষ্টিকর খাবার ও যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আর মায়েরা তাদের সন্তানদের পুরো দুবছর বুকের দুধ দেবে, যদি কেউ দুগ্ধদানের দায়িত্ব পূর্ণ করতে চায়। এ-ক্ষেত্রে পিতা যথাযথ খোরপোষ দেবে” (সূরা বাকারা:২৩৩)।
বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে জাতীয় পুষ্টিনীতি গৃহীত হয়েছে। সরকার পুষ্টিহীনতা রোধ করতে নানামুখী কর্মসূচি পালন করে আসছে। ১৯ এপ্রিল থেকে পালিত হচ্ছে জাতীয় পুষ্টি সপ্তাহ। পুষ্টিহীনতা দূর করতে প্রত্যেক নাগরিকের স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করা জরুরি। কারণ, সবল ব্যক্তি মানে সবল জাতি। আর সবল মা ও শিশু মানে দেশের সুন্দর ভবিষ্যৎ। ধর্মীয় দায়বদ্ধতা থেকেও পুুুষ্টিহীনতা দূর করা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সবল মানুষ দুর্বলের চেয়ে ইবাদত বেশি করতে পারে। আর সুস্থ থাকা ও সুস্থ রাখার প্রচেষ্টাও ইবাদত।
ড. মুহাম্মদ নুর হোসাইন
সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সূত্রঃ দৈনিক পূর্বকোণ (৩০.০৪.২১) ২য় পৃষ্টায়
প্রকাশিত।