খবরের বিস্তারিত...


আসন্ন রমজান, দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি ও করণীয়–এম ইব্রাহীম আখতারী।

পবিত্র রমজানের রোজা ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের অন্যতম একটি। মুসলমানদের জন্য এটি একটি ফরজ ইবাদত। প্রতিটি মুসলমানদের জন্য যেটির যথার্থ পালনের আবশ্যকীয়তা রয়েছে। যৎকারণে মুসলমান মাত্রই ইসলামের এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে মুখিয়ে থাকে। কেননা রমজানের রোজা পালনের মধ্য দিয়ে ধর্মানুরাগী মানুষ বিশুদ্ধ ও স্খলনমুক্ত চরিত্র গঠনসহ আত্নিক উৎকর্ষতা সাধনে ব্রতী হয়। ফলে অত্যন্ত ভাবগাম্ভীর্যতার সাথে এ পূন্যময়ী মাসের সেলিব্রেশন তাবৎ মুসলিম কমিউনিটির নিকট অধিকতর প্রত্যাশিত থাকে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে, এক্ষেত্রে অত্যন্ত লজ্জাজনকভাবে দৃশ্যমান হয় ঠিক তার উল্টো চিত্র। কোনভাবেই নির্বিঘ্ন হয়না মাহে রমজানের পবিত্র এ রোজা পালন। কেননা এসময়ে অনাকাঙ্খিতভাবে অভিশপ্ত “শনি” ভর করে নিত্যপন্যের উপর।

রমজানের আগমনী বার্তার সাথে সাথে বাজারে পন্যমূল্য বৃদ্ধি পেতে থাকে অনেকটা প্রতিযোগীতামূলকভাবে। ফলে ভিন্ন চেহারায় দৃশ্যমান হয় বাজার। যা শুধু দূঃখজনক নয় বরং গ্লানিকরও বটে।

যাইহোক, কালের ধারাবাহিকতায় প্রতি বছরের ন্যায় এবারও অবর্ণনীয় রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের সওগাত নিয়ে মুসলিম কমিউনিটির দ্বারপ্রান্তে কড়া নাড়ছে এ পবিত্র রমজান। বিশ্ব মুসলমান রমজানের রোজা পালনের জন্য প্রাক প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়! এমনই এক মাহেন্দ্রক্ষনে চাল, ডাল, তেল, ছোলা, চিনিসহ ইত্যাকার নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর দাম এখন থেকেই আকাশচুম্বী । ক্রমাগত লাফাচ্ছে,যেন এক পাগলা ঘোড়া। যা ইতোমধ্যেই সাধারণের ক্রয়ক্ষমতা বহির্ভূত হয়ে পড়েছে। ফলশ্রুতিতে দৈনন্দিন নাগরিক জীবনযাত্রায় সংকট তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। উল্লেখ্য যে, প্রতি বছরই পবিত্র মাহে রমজান এর পূর্বে এরূপ দৃশ্যমান হয়। কিন্তু কেন? এমনটি হওয়ার তো কথা নয়। কারণ এ কথা কোনভাবেই বিস্মৃত হবার নয় যে, এটি হচ্ছে একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। যেথায় 92 শতাংশ মুসলমান এর আবাস। উপরন্তু এটি বিশ্বের 2য় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র। সুতরাং এরকম একটি দেশের মানুষ তাদের যে কোন ধর্মীয় উৎসব,পালা-পার্বণ ইত্যাকার বিষয়াদি অত্যন্ত ভাব-গাম্ভীর্যতাসমেত নিরুপদ্রবভাবে উদযাপন করবে,এরকম প্রত্যাশা থাকে সকলেরই। অথচ এসময়ে নিত্যপন্যের লাগামহীন উর্ধগতির কারণে সাধারণ মানুষের রোজা পালন খুবই কষ্টসাধ্য হওয়া ছাড়াও নানবিধ দুর্ভোগ ভোগান্তির শিকার হতে হয়।সত্যিকার অর্থে এক্ষেত্রে কোনপ্রকার প্রতিবন্ধকতা মোটেও কাম্য হতে পারে না।

অনস্বীকার্য বাস্তবতা হলো,অধিক মুনাফালোভী একটি ব্যবসায়িক দুষ্টচক্র এহেন গর্হিত কাজের সাথে জড়িত থাকে। এরা পবিত্র রমজানকেই টার্গেট করে ওঁৎ পেতে থাকে। এদেের এমনই একটি মনোবৃত্তি, যেন এরা সারা বছর কোন ব্যবসা-বানিজ্য করতে পারে নি। ফলে রমজান মাসেই এদেরকে সারা বছরের ব্যবসায়িক সাফল্য অর্জন করতে হবে। তাই এরা অতি মুনাফার লোভে অবাঞ্ছিত সিন্ডিকেট সৃষ্টির মাধ্যমে অপ্রত্যাশিতভাবে নিত্যপণ্য অবৈধভাবে গুদামজাত করে। ফলে বাজারে নিত্যপন্যের অপ্রতুল সরবরাহের দরুন বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়। আর ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে পন্যমূল্য। অথচ খাদ্যদ্রব্য মজুদ করে রাখা অথবা তা বাজার থেকে তুলে নিয়ে দাম বৃদ্ধি করা ইসলামে অবৈধ। হানাফি মাজহাব মতে মাকরূহে তাহরিমি (হারাম সমতুল্য)। আর অন্যান্য মাজহাব মতে এটি হারাম। কেননা এধরনের ঘৃন্য কাজে সাধারণ মানুষ ভোগান্তির শিকার হয়।। তাই ইসলাম এধরনের কাজকে হারাম ঘোষণা করেছে। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের খাদ্যশস্য মজুদ রাখে, আল্লাহ তার ওপর দারিদ্রতা চাপিয়ে দেন।
(আবু দাউদ, হাদিস নং : ৫৫)
ব্যবসায়িক পণ্য বিক্রি না করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে বর্ধিত মুনাফা আদায়ের প্রচেষ্টা একটি সামাজিক অপরাধ। রাসুল (সা.) বলেছেন, যে খাদ্যশস্য গুদামজাত করে সে অভিশপ্ত। (ইবনে মাজাহ) এছাড়াও যে ব্যক্তি ৪০ দিনের খাবার মজুদ রাখে, সে আল্লাহর জিম্মা থেকে বেরিয়ে যায়। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ২০৩৯৬) এমনকি যে ব্যক্তি খাদ্যশস্য গুদামজাত করে সে অপরাধী।
(আল মু’জামুল কাবির : ১০৮৬) এ কথা অনস্বীকার্য যে, দ্রব্যমূল্যের সাথে মানুষের জীবনযাপনের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। মানুষের জীবন নির্বাহের সামগ্রিক কর্মপন্থা নির্ণীত হয় তাদের আয়ের উৎস, চাহিদা এবং দ্রব্যমূল্যের উপরই। এক্ষেত্রে যদি কোনপ্রকার ব্যত্যয় ঘটে,তাহলে সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে আসে অশান্তি। এমনকি অর্ধাহার-অনাহার তথা অভুক্ত থাকতে হয় অনেককেই। এমনিতেই গত ২ বছর বৈশ্বিক মহামারি অভিশপ্ত করোনা ভাইরাসের অশুভ শিকারে পরিণত হয়ে সাধারণ মানুষের ত্রাহি অবস্থা। লকডাউন এর যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়ে কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষগুলো এখনো মেরুদণ্ড সোজা করতে পারেনি। উপরন্তু পূনরায় আবারও অভিশপ্ত লকডাউনের কবলে পতিত হয়েছে দেশ। এমতাবস্থায় পন্যমূল্যের উর্ধগতি রোধ করা না গেলে সামজিক জীবনে নেতিবাচক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। তাই এ মূহুর্তে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সক্রিয় ও দায়িত্বশীল ভূমিকায় এগিয়ে আসতে হবে। সর্বাগ্রে বাজারকে কঠোর নজরদারির আওতায় আনতে হবে। জোরদার মনিটরিং অব্যাহত রেখে ভোগ্যপন্যের সরবরাহ বৃদ্ধি এবং মূল্য সহনীয় পর্যায়ে আনতে হবে। সরকারি বিপনন সংস্থা টিসিবিকে অধিকতর গতিশীল করতে হবে এবং যাতে সাশ্রয়ী মূল্যে দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করা যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। টিসিবির কোন পন্যের মূল্য বৃদ্ধি করা যাবে না। কারণ টিসিবি কর্তৃক মূল্য বৃদ্ধি করা হলে বাজারে এর মিশ্র প্রভাব পড়বে। এছাড়াও অবিলম্বে মোবাইল কোর্ট এর মাধ্যমে কম্বিং অপারেশন পরিচালনা করে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করতে হবে। পাশাপাশি এসব দেশদ্রোহীদের গ্রেপ্তার পূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় ক্রমাগত জনমনে যে ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে,তা ভিন্ন আকার ধারণ করলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। উল্লেখ্য যে,
অতি সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন- দেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশের তকমা ঘুচিয়ে উন্নয়নশীল দেশে পা রেখেছে। নিঃসন্দেহে বলা যায় এটি এক মহাঅর্জন। এছাড়া ইতোপূর্বে আরও অনেক জাতীয় অর্জন আমাদের প্রাপ্তির খাতায় যোগ হয়েছে। এজন্য বর্তমান সরকার সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। তবে প্রশ্ন হলো, এদেশের কত শতাংশ মানুষ এসব বিষয়ের সাথে পরিচিত? কয়জনই বা বুঝে নিম্ন আয়ের দেশ, স্বল্পোন্নত দেশ, উন্নয়নশীল কিংবা উন্নত দেশ সম্পর্কে। কতজনই জ্ঞাত দেশের প্রবৃদ্ধি তথা রিজার্ভ ইত্যাকার বিষয়াদি। তবে এক্ষেত্রে অধিকাংশই একান্তভাবে প্রত্যাশা করে দৈনন্দিন দু’বেলা দু’মুঠো ভাত এর নিশ্চয়তা। নিরুপদ্রব ও নিস্কন্টকভাবে জীবনযাপন। ইজ্জত – আব্রুর গ্যারান্টি। একজন নাগরিক হিসেবে চাই কেবলই তাদের ন্যায্য অধিকারটুকুন। যা রাষ্ট্রের নিয়ন্তারা কখনও এড়িয়ে যেতে পারেন না। স্মরণ রাখতে হবে যে,দেশের সিংহভাগ জনগণের পাল্স বুঝার ক্ষেত্রে যদি কোনরূপ ব্যত্যয় ঘটে, তাহলে কোনপ্রকার অর্জনই জাতীয় জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারবে বলে মনে হয়না। অতএব,দেশের গরিব-দুস্থ মানুষের চাহিদা উপেক্ষিত হয়ে উন্নয়নশীল দেশের তৃপ্তির ঢেকুর তোলা কেবলই বিলাসিতা হিসেবেই বিবেচিত হবে।

লেখক–অধ্যক্ষ এম ইব্রাহীম আখতারী
প্রাবন্ধিক ও রাজনীতিবিদ।
ই-মেইলঃ mdibrahimakhtari@gmail.com

সূত্রঃ ১০ এপ্রিল ২০২১ইং, দৈনিক পূর্বকোণ প্রকাশিত

[related_post themes="flat" id="1576"]