ইসলামে স্বাস্থ্য সচেতনতা ও কোভিড১৯ মোকাবেলা প্রসঙ্গে –ড. মুহাম্মদ নুর হোসাইন
বাংলাদেশে কোভিড-১৯ সদর্পে ফিরে এসেছে। গত বছরের তুলনায় সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি। গত বছর অপ্রস্তুত এবং আতঙ্কিত ছিল বিধায় মানুষ মারা গেছে। এখন কিছুটা প্রস্তুতি আছে, কিন্তু অসাবধানতা ও অসচেতনতার কারণে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ও মারা যাচ্ছে। অবশ্য, প্রয়োজনের তুলনায় প্রস্তুতি অপ্রতুল। সম্পূর্ণ প্রস্তুতি থাকলেও এমন মহামারি মোকাবেলা করা যাবে- এমনটি নয়। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোও পারেনি। তবে স্বাস্থ্য সচেতনতা ও স্বাস্থ্যবিধি মানার মাধ্যমে ক্ষতির পরিমাণ কমানো যাবে মর্মে বিশেষজ্ঞগণ বার বার বলে আসছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অন্যান্য বিধির ন্যায় করোনাতেও স্বাস্থ্যবিধি তেমন গুরুত্ব পায়নি। এর কারণ হলো, করোনার চরিত্র বুঝতে না পারা, পূর্ব থেকে আইন না মানার অভ্যাস, অশিক্ষা, অভাব, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা ইত্যাদি। অশিক্ষিত বা দরিদ্র শ্রেণি স্বাস্থবিধি তো মানছে না বা মানতে পারছে না, শিক্ষিতদের অনেকেও অবহেলা করছেন চরমভাবে। মৃত্যুর হার কিছুটা কমে আসা মাত্র পারিবারিক-সামাজিক-রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সভা-সামাবেশ দেদারসে হয়েছে, যখন অন্যান্য দেশে মৃত্যুর মিছিলের খবর আসছিল। সংশ্লিষ্টগণ বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে শুধু মাস্ক পরার অনুরোধের মধ্যে এসে থেমেছেন। সেটাও মানানো যায়নি। সরকার মাস্ক না পরলে জরিমানার ব্যবস্থা করেছে এবং ইতিমধ্যে অনেককে জরিমানা গুণতে হয়েছে। “মাস্ক নেই তো সেবা নেই” শ্লোগান অফিসে অফিসে লিখে দেয়া হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ মাস্ক পরছে না। যারা পরছে তাদের মাস্ক স্বাস্থ্যসম্মত না। আবার অনেকে এখানেও দুর্নীতির আশ্রয় নিচ্ছে। অর্থাৎ মাস্ক আছে, তবে মুখ ও নাক ঢাকা নেই; ঢেকে আছে থুতনি। এটা প্রকান্তরে নিজের সাথে প্রতারণা। অনেকেই করোনার প্রথম ডোজ নিয়েই যেন সম্পূর্ণ নিরাপদ হয়ে গেছে। অথচ কোন টিকাতেই শতভাগ নিশ্চয়তা নেই। দুই ডোজ নেয়ার পরও ১৪ দিন পর্যন্ত সাবধানে থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তাও আবার জনগণের সবাই যদি টিকা না নেই তাহলে টিকাগ্রহণকারীও নিরাপদ না। মোটকথা, করোনার সংক্রমণ রোধ করতে স্বাস্থ্য সচেতনতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোন বিকল্প নেই। ধর্মীয় ব্যক্তিদের অনেকেই নিজে স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না, আবার অন্যদেরকে মানতে অনুৎসাহিত করছেন। এখনো ফতোয়া দিচ্ছেন, মাস্ক পরে নামায আদায় করলে হবে না, দূরত্ব বজায় রেখে কাতার করা যাবে না, হাত মিলাতে হবে, গলাগলি করা যাবে, ধর্মীয় সমাবেশ করা যাবে, টিকা নেয়া নাজায়েয ইত্যাদি। এমনকি একটি জামাত সুন্নাত আদায়ের নামে করোনাকালীনও মসজিদে জমায়েত হয়ে একই প্লেটে ৬/৭ জনে খাবার গ্রহণের অভ্যাস চালু রেখেছে। পৃথিবীব্যাপী ২৮ লক্ষের বেশি মানুষ মারা যাওয়ার পরও এখনো খুড়া যুক্তি দিয়ে যাচ্ছে যে, হাট-বাজার চালু আছে, বিভিন্ন স্থানে জমায়েত চলছে মসজিদ-মন্দিরে কেন দূরত্ব বজায় রাখবে বা মাস্ক পরবে? অর্থাৎ তারা ধর্মচর্চা করতে এসেও আইন ভঙ্গ এবং নিজের ও অপরের ক্ষতিসাধন করতে প্রস্তুত! অথচ অনিয়ম কোনদিন মডেল হতে পারে না।
এভাবে নিজের বা অন্যের ক্ষতি করার অধিকার ইসলাম ধর্মে অননুমোদিত। কেউ চাইলে অনর্থক নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিজে নষ্ট করতে পারে না; এমনকি ভালো নিয়তেও না। যেমন, কিছু সাহাবি বেশি এবাদত-বন্দেগি করার সুবিধার্থে নংপুরুষ হওয়ার অনুমতি চাইলে আল্লাহর রাসূল (দ.) নিষেধ করে দিলেন। তিনি আত্মহত্যাকে মহাপাপ ঘোষণা করেছেন। নিরাপরাধ কাউকে হত্যা করা মানে পুরা মানব জাতিকে হত্যা করার শামিল বলে পবিত্র কুরআনে ঘোষিত হয়েছে। আত্মহত্যা ও খুন ইচ্ছাকৃত হতে পারে, ইচ্ছাকৃত সদৃশ হতে পারে, আবার ভুলবশতও হতে পারে। প্রত্যেক প্রকারের হত্যার জন্য ইহপরকালীন শাস্তি নির্ধারিত আছে। অনিচ্ছাকৃত হত্যার পার্থিব শাস্তি হলো একশটি উটের মূল্য। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা করোনার স্বাস্থ্যবিধির ব্যাপারে একমত হওয়া এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা প্রধান অবলম্বন বলে মতামত দেয়ার পর কেউ যদি অবহেলা করে নিজে বা অন্যের আক্রান্ত হওয়ার কারণ হয় এবং মারা যায় তাহলে সে সরাসরি আত্মহত্যাকারী বা খুনি না হলেও অনিচ্ছাকৃত আত্মহত্যাকারী ও খুনির মধ্যে শামিল হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। যেমন সামর্থ্য থাকা সত্বেও কোন রোগী যদি ওষুধ সেবন না করে তাহলে সে আত্মহত্যাকারীর মধ্যে গণ্য হবে। আল্লাহর নবি (দ.) রোগীকে চিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছেন এবং বলেছেন, “নিশ্চয় প্রত্যেক রোগের চিকিৎসা আছে” (ছহিহ ইবন হিব্বান: ৬০৬৩)।
আত্মরক্ষার প্রচেষ্টা তাকদিরের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। বাঁচার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা বড় ফরজ। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে বার বার আত্মরক্ষার তাগিদ দেয়া হয়েছে। তাগিদ দেয়া হয়েছে সুস্থ জীবন-যাপনের প্রচেষ্টার জন্য। বলা হয়েছে, “তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়োনা” (সূরা বাকারা: ১৯৫)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, “তোমরা সাধ্যমত শক্তি যোগাড় করো (আল-আনফাল: ৬০)। আরো বলা হয়েছে, “তোমরা তোমাদের রক্ষার হাতিয়ার গ্রহণ করো (সূরা নিসা: ৭১)। প্রচেষ্টা ছাড়া কেউ কিছু পাবে না মর্মে ঘোষণা হয়েছে পবিত্র কুরআনে। বলা হয়েছে, “চেষ্টা ছাড়া করো জন্য কিছু নেই” (সূরা নজম: ৩৯)। এমনকি কোন জাতির ভাগ্যও পরিবর্তন হবে না, যদি না তারা সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টা চালায়। যেমন বলা হয়েছে, “আল্লাহ তায়ালা কোন জাতির অবস্থা বদলান না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা বদলানোর চেষ্টা করে (সূরা রা‘দ: ১১)। আল্লাহর নবি (দ.) বলেছেন, “যার দিনের সূচনা হয় প্রশান্ত মনে, সুস্থ শরীরে এবং তার নিকট সেই দিনের খাবার মওজুদ থাকে তাহলে সে যেন দুনিয়া জয় করলো (তিরমিযি: ২৩৪৬)।
উল্লিখিত আয়াত ও হাদিসের আলোকে বলা হয়েছে, ইসলামি শরিয়ার বিধানাবলির মূল উদ্দেশ্য সমূহের প্রথম হলো আত্মরক্ষা করা বা জীবন বাঁচানো। জীবন রক্ষার ফরজ আদায় করতে গিয়ে যদি অন্য ফরজ ছেড়ে দিতে হয় তাহলেও সেটি করতে হবে। যেমন যুদ্ধ ময়দানে নামায কাযা করা যাবে। কেউ পুকুরে পড়ে গেলে তাঁকে উদ্ধার করতে বা আগুন লাগলে নিভাতে গিয়ে নামায বা অন্য ফরজ কাজ ছেড়ে দিতে হবে। অপরদিকে জীবন রক্ষার তাগিদে সবচেয়ে হারাম খাবারও জায়েয। যেমন অন্য কোন খাবার পাওয়া না গেলে জীবন রক্ষার তাগিদে সবচেয়ে নাপাক শূকরের মাংসও খাওয়া যাবে। এভাবে ইসলামে জীবনরক্ষার তাগিদ দেয়া হয়েছে। আর জীবনরক্ষার জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্য সচেতনতা। ইসলামের প্রত্যেকটা বিধান স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক। প্রত্যেকটির মধ্যে স্বাস্থ্যগত ও মানসিক উপকার রয়েছে, বিশেষত প্রাসঙ্গিক ইবাদত বা ইবাদতে গাইরে মাকসূদার মধ্যে। যেমন, অযু, গোসল, মিসওয়াক ইত্যাদিতে। ইসলামি খাদ্যাভ্যাসেও স্বাস্থ্য সচেতনতা পরিপূর্ণভাবে বিদ্যমান।
আরবি একটি প্রবাদ আছে, “আল-বিক্বায়াহ খাইরুম মিনাল ‘আলাজ” অর্থাৎ চিকিৎসা হতে সচেতনতা উত্তম। মুত্তাকি শব্দটা এসেছে, “আল-বিক্বাইয়া” থেকে। তাই আধুনিক যুগের অনেক অনুবাদক মুত্তাকি শব্দের অনুবাদ করেছেন “আল্লাহ সচেতন” বলে। সূরা বাকারার প্রথম আয়াতে মুমিনদেরকে মুত্তাকি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। শব্দটি পবিত্র কুরআনে এসেছে বার বার। একজন মুত্তাকি মানে যিনি নিজের ও পরের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন। অপরদিকে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল (দ.)-এর আদেশ-নিষেধ মেনে চলাকে তাকওয়া বলা হয়। তাকওয়া ও আল-বিক্বায়া প্রতিশব্দ। আর আদেশ-নিষেধ মেনে চলতে হলে অবশ্যই শারীকিভাবে সুস্থ হতে হবে। শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে হলে স্বাস্থ্য সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই। আল্লাহর নবি (দ.) বলেছেন, দুর্বল মুমিনের চেয়ে সবল মুমিন অধিক কল্যাণকর এবং আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়, তবে উভয়ের মধ্যে কল্যাণ রয়েছে (মুসলিম: ২৬৬৪)। অন্য হাদিসে বলা হয়েছে, তোমরা অসুস্থ হওয়ার পূর্বে সুস্থতাকে গুরুত্ব দাও (হাকেম: ৭৮৪৬)। আরো বলা হয়েছে, “অধিকাংশ মানুষ দুটি নিয়ামতের ব্যাপারে প্রতারিত হয়- সুস্থতা ও অবসর (বুখারি: ৬৪১২)। সুস্থ ও অবসর অবস্থায় ইহপরকালীন কল্যাণকর কাজ না করা মানে প্রতারিত হওয়া। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়াল বান্দাকে সর্বপ্রথম তার সুস্থতার নিয়ামত সম্পর্কে প্রশ্ন করে বলবেন, আমি কি তোমাকে শারীরিক সুস্থতা দেইনি? (তিরমিযি: ৩৩৫৮)।
বৈজ্ঞানিক বিচার-বিশ্লেষণে প্রমাণিত যে, আল্লাহর নবি (দ.)-এর জীবনাচারের প্রত্যেকটি দিক এবং দৈনন্দিন প্রত্যেকটি কাজ যেমনি ছিল যুক্তিপূর্ণ ও কল্যাণকর তেমনি স্বাস্থ্যসম্মত। করোনা মহামারির সংক্রমণ থেকে রক্ষার উপায় হিসেবে বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞান যে দিকনির্দেশন দিয়েছে দেড় হাজার বছর পূর্বে তিনি তার সবটুকুই বলে গেছেন এবং অনুশীলন করে গেছেন। বার বার হাত ধোয়া, হাঁচি ও কাশি দেয়ার সময় নাকমুখ ঢেকে রাখা, মহামারিকালীন ঘরে অবস্থান করা, আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে দূরত্বে অবস্থান করা, মহামারিকালীন ভ্রমণ বন্ধ রাখা ইত্যাদির প্রত্যেকটি বিষয়ে সুস্পষ্ট একাধিক হাদিস আছে। তাই তাঁর সুন্নাহ ও বিজ্ঞান সমার্থক। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “তিনি তোমাদের কিতাব ও হিকমা শিক্ষা দেন” (আল-বাকারা: ১৫১)। বিশেষজ্ঞগণ হিকমা-এর দুটি অর্থ বলেছেন, বিজ্ঞান ও সুন্নাহ। এখন প্রমাণিত যে, সুন্নাহ ও বিজ্ঞান একই জিনিস। তাই যে কোন রোগ থেকে বাঁচার এবং সুস্থ জীবন যাপনের জন্য তাঁর জীবনপদ্ধতি যুৎসই। তাঁর অনুসারীদেরকে তিনি নিজের সুন্নাহতে অভ্যস্ত করতে সক্ষম হওয়াতে তাঁরাও স্বাস্থ্য সচেতন ছিলেন। ফলে তাঁদের মধ্যে তেমন কোন রোগ ছিল না। একজন বিদেশী চিকিৎসক এসে সাহাবিদেরকে চিকিৎসা দিতে চাইলে তিনি অনুমতি দিলেন। কিন্ত চিকিৎসা দেয়ার মত মদিনায় কোন রোগী পাওয়া গেল না।
সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সূত্রঃ (৯/৪/২০২১)দৈনিক পূর্বকোণ দ্বিতীয় পৃষ্ঠা।
[related_post themes="flat" id="1573"]