খবরের বিস্তারিত...


স্মৃতিতে অধ্যক্ষ আল্লামা জালাল উদ্দীন আলক্বাদেরী (রহঃ) ~~ আল্লামা জুবাইর

স্মৃতিতে অধ্যক্ষ আল্লামা জালাল উদ্দীন আলক্বাদেরী রহঃ
~~লিখেছেনঃ মুহাম্মদ জয়নুল আবেদীন জুবাইর

যুগে যুগে যে সকল ক্ষণজম্মা মহাপুরুষদের শুভ আবির্ভাবে এ দেশের জাতীয় ইতিহাস সমৃদ্ধ হয়েছে,তম্মধ্যে আল্লামা জালাল উদ্দীন আল ক্বাদেরী রহঃ এর বর্ণাঢ্য কর্মযজ্ঞ ও স্বীয় প্রতিভাগুণে তাঁদের অন্যতম একজন হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।আল্লামা জালাল উদ্দীন আল ক্বাদেরী জীবন্ত এক কিংবদন্তীর নাম। সর্বমহলে যার রয়েছে গগণচুম্বী জনপ্রিয়তা।যিনি জগৎজোড়া খ্যাতি ও মর্যাদার শীর্ষ আসন দখলকারী একজন উঁচুমাপের ব্যক্তিত্ব।জাতি,ধর্ম,বর্ণ,দলমত নির্বিশেষে তাঁকে চিনে না,জানে না এমন কেউ আছে বলে মনে হয় না। বিগত ২৬ নভেম্বর ২০১৬ ইং, শনিবার মহান স্রষ্টার আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশ – বিদেশের অসংখ্য অগণিত ভক্ত, অনুরক্ত,শুভানুধ্যায়ীদের শোক সাগরে ভাসিয়ে যিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। বিগত ২৬ নভেম্বর ২০১৬ ইং ঠিক রাত ১০:১৪ মিনিটে আমার ফোন বেজে উঠল।দেখলাম ঢাকার আজিমপুর জামে মসজিদের খতিব ও বাংলাদেশ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের কেন্দ্রীয় নেতা আল্লামা মোশাররফ হোসাইন হেলালীর ফোন,রিসিভ করার সাথে সাথে ভেসে আসল কান্না বিজড়িত কন্ঠ।কি হয়েছে জানতে চাইলেই বললেন,জালাল সাহেব হুজুর আর নেই।কেন জানি বিশ্বাসই হচ্ছিল না কথাটি। বারবার জানতে চাইলে উনি বললেন,ঠিক রাত ১০:১৩ মিনিটে হুজুর শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করেছেন।বললেন,জুবাইর ভাই সর্বপ্রথম আপনাকে ফোন করলাম।উনি তখন হাসপাতালে হুজুরের শষ্যাপাশে অবস্হান করছিলেন। এ অপ্রিয় সত্য কথাটি যেন হৃদয়ে তীরের মত বিদ্ধ করল।কেন জানি হঠাৎ বজ্রপাতের আঘাতের ন্যায় পুরো দেহটি নিথর – নিস্তব্দ হয়ে গেল।ক্ষণিকের জন্য চেতনা শক্তি হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। কোনমতেই মেনে নিতে পারছিলাম না এ দুঃসংবাদটি। বড়ই অসহায় বোধ করছিলাম।রকমারি বিষয়াদি ঘুরপাক খাচ্ছে মানসপটে।মনে হলো অভিভাবক হারা হয়ে গেলাম।কেননা আমার ছাত্র জীবন থেকেই খতিবে বাঙাল আল্লামা জালাল উদ্দীন আল ক্বাদেরী রহঃ এর সাথে ছিল পারিবারিক সুনিবিড় সম্পর্ক। ছাত্রবস্হায় হুজুর যখন দারুল উলুম ফাযিল ক্লাসের ছাত্র,আমি তখন জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়াতে ৭ম শ্রেণীর ছাত্র।বাসযোগে মাদ্রাসায় আসা যাওয়ার পথে প্রতিদিন আমার সাথে চট্রগ্রাম স্টেশন রোডে সাক্ষাত হতো। এরই সুবাদে পরস্পরের মধ্যে সম্পর্কের সেতু বন্ধন সৃষ্টি হয়।কিছুদিন পর আগ্রাবাদ সিজি এস কলোনী জামে মসজিদে খতিব হিসেবে যোগদান করেন এবং পরবর্তীতে আগ্রাবাদ বহুতলা কলোনী মসজিদে দীর্ঘ সময় খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। এরই সুববাদে হুজুরের সাথে আমার সম্পর্ক গভীর হয়ে উঠে। মসজিদে দায়িত্ব পালনের কারণে আমার আগ্রাবাদের বাড়িতে নিয়মিত আসা যাওয়া করত।এমনকি হুজুরের জুমার লেবাস ও আমার বাসায় রক্ষিত থাকত।আমাদের বাসা থেকে নিয়মিত প্রস্তুত হয়ে জুমার নামাযে ইমামতি করতে যেতেন। তৎসময়ে রাস্তা ঘাট তেমন উন্নত ছিল না। বর্ষাকালে কাদার কারণে জুতা পায়ে দিয়ে মসজিদে জুতা পায়ে দিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না বিধায় আমি নিজেই হুজুরের জুতা বহন করে একসাথে যাতায়াত করতাম। তখন থেকেই হুজুরের সাথে আমি এবং আমার পরিবারের মধ্যে সখ্যতা এবং হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে। যাই হোক,আমি যখন দাখিল ৯ম শ্রেণীর ছাত্র,হঠাৎ দেখি একদিন জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার ২ জন কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব গাজ্জালিয়ে জামান অধ্যক্ষ আল্লামা মোসলেহ উদ্দীন রহঃ ও উপাধ্যক্ষ আল্লামা মোজাফফর আহমদ রহঃ আমাদের ক্লাসে আল্লামা জালাল উদ্দীন আল ক্বাদেরী রহঃ কে নিয়ে এলেন। উনাকে অত্র মাদ্রাসার মোহাদ্দিস হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন। তাৎক্ষণিকভাবে আমি পুলকিত হলাম।আমার পরিচিত একজন আপনজন আমার শিক্ষক।আনন্দের কোন সীমা ছিল না।তখন থেকেই হুজুর আমার যাবতীয় বিষয়ের দেখভাল করা সহ প্রতিটি বিষয়ের খোঁজখবর নিতেন।উপরন্তু আমাকে তিনি পিতৃস্নেহে শিক্ষা দান করেন।ফলে ছাত্র জীবন থেকে হুজুরের অানুকূল্যে আমার জীবনে বহুমাত্রিক সফলতার নাগাল পেয়েছি।তাঁর নিকট আমি আজীবন কৃতজ্ঞ ও ঋণী হয়েই থাকবো।আল্লামা জালাল উদ্দীন আল ক্বাদেরী রহঃ ১৯৪৪ সালের ২৪ জুলাই চট্রগ্রাম জেলাধীন পটিয়া থানার অন্তর্গত চরকানাই গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জম্মগ্রহণ করেন।গ্রামেই প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে তিনি চট্রগ্রাম শহরের দারুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসা থেকে মাদ্রাসা বোর্ডের সর্বোচ্চ স্তর কামিল হাদিস অতঃপর ছারছিনা মাদ্রাসা থেকে কামিল ফিকাহ অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে উর্ত্তীণ হন।পরবর্তীতে তিনি চট্রগ্রাম কলেজ থেকে কৃতিত্বের সহিত স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।ছাত্র জীবনেও তিনি একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠানের ছাত্র- শিক্ষকের সমীহ আদায় করেন।মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে শুধু শ্রেণী কক্ষে নয় গোটা প্রতিষ্ঠানেই তাঁর বীরোচিত আধিপত্য ছিল বলেই প্রচার রয়েছে।একজন মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে কর্ম জীবনের শুরুতে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নীয়া আলিয়ার মোহাদ্দিস পদে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। শিক্ষকতা পেশায় দারুন নৈপুণ্যতা প্রদর্শন করায় মাদ্রাসা কতৃপক্ষ তাঁকে এক পর্যায়ে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ প্রদান করেন।তখন থেকেই শুরু হয় তাঁর পথচলা।আল্লামা জালাল উদ্দীন আল ক্বাদেরী রহঃ এশিয়ার স্বনামধন্য দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার প্রায় ৪৩ বছর একটানা শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। ১০ বছর মোহাদ্দিস পদে থাকার পর ৩৩ বছর অধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত থেকে তিনি কোরআন – হাদিসের পাঠদানের মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন দ্বীনি খেদমত আনজাম দিয়ে গেছেন। সত্যিকার অর্থে যে কোন কারো পেশাগত জীবনে এটিও একটি বিরল ঘটনা।পেশাগত জীবনে একজন শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ ও শ্রেষ্ঠ শ্রেণী শিক্ষক হিসেবে তিনি একাধিক এ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন।তাঁর বণাঢ্য জীবনের অপর একটি মাইলফলক হলো চট্রগ্রাম জমিয়তুল ফালাহ মসজিদের খতিব হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ।উল্লেখ্য যে,এ ঐতিহাসিক মসজিদের খতিব নিয়োগ এর ক্ষেত্রে বিভিন্ন মত ও আক্বীদার অসংখ্য আলেম প্রার্থী হিসেবে আবেদন করেন।আশ্চার্য্যজনক হলেও সত্য যে,আল্লামা জালাল উদ্দীন আল ক্বাদেরী সকলকে পেছনে ফেলে বহুল কাংখিত উক্ত খতিব পদ অর্জনে সমর্থন হন।তাঁর মেধা,দাতা,যোগ্যতার মাধ্যমে তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর কাড়েন।আল্লাহর অপার এক মহিমায় এ কঠিন দায়িত্ব পালনকালেও তিনি এক ও অদ্বিতীয় হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন। এ ঐতিহাসিক মসজিদের প্রতিষ্ঠাকালিন সময় থেকে ইন্তেকাল অবধি খতিবের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত থেকেও বিরল এক দৃষ্টান্ত স্হাপন করেন তিনি।তার ইমামতিতে জুমার নামায আদায় করার অভিপ্রায়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অসংখ্য ধর্মপ্রাণ মুসল্লি ছুটে আসতেন দেশের বৃহত্তম ২য় এ মসজিদে। আল্লাহর আরশ কাপানো তার হৃদয়গ্রাহী খুতবা,বক্তব্য ও মুনাজাত শোনার জন্য হাজার হাজার মুসল্লি তীর্থের কাকের ন্যায় অপেক্ষায় থাকতেন চরম ধৈয্য সহকারে।উক্ত মসজিদে বিগত ৩১ বছর ধরে তিনি আহলে বায়তে রাসূল দঃ এর স্বরণে ১০ দিন ব্যাপী ঐতিহাসিক আন্তর্জাতিক শাহাদাতে কারবালা মাহফিল সূচনা করেন,যে মাহফিল ইসলামী সংস্কৃতিতে ভিন্ন এক মাত্রা যোগ করে নিঃসন্দেহে। উপরন্তু এই মাহফিল এক পর্যায়ে আন্তর্জাতিক রুপ লাভ করে।দেশ- বিদেশের ঐতিহাসিক ইসলামী স্কলারদের মিলনমেলা ঘটে এ ঐতিহাসিক মাহফিলে।ধর্মানুরাগী অসংখ্য শ্রোতামন্ডলী এদের জ্ঞানগর্ভ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শুনে উপকৃত ও ধন্য হয়ে থাকেন।শুধু তাই নয়,এ মাহফিল সত্যানুসন্ধানী ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালায় রুপান্তরিত হয় ক্রমাগতভাবে। আল্লামা জালাল উদ্দীন আল ক্বাদেরী রহঃ এর অকৃত্রিম ভালবাসা সুলভ নির্দেশে আমিও বেশ কয়েক বছর ধরে উক্ত মাহফিলের আলোচক হিসেবে আমন্ত্রিত হয়।যা আমার নিকট মৃত্যু অবধি বিস্মৃত হবার নয়। আশা করি এ ঐতিহাসিক শাহাদাতে কারবালা মাহফিল ভবিষ্যতেও সুন্নীয়তের বৃহত্তর ঐক্যের স্মারক হয়ে থাকবে।কার্যক্ষেত্রে আল্লামা জালাল উদ্দীন আল ক্বাদেরী রহঃ এর নৈপুন্যতা ও বিচক্ষণতা বিবেচনায় নিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাকে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীনস্হ ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ এর বোর্ড অব গভর্নরস এর সম্মানিত গভর্নর নিয়োগ করেন।রাষ্ট্রীয় জনগুরুত্বপূর্ণ উক্ত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও তিনি সর্বত্র প্রশংসিত হন।

ব্যক্তিজীবনে আল্লামা জালাল উদ্দীন আল ক্বাদেরী ছিলেন সদালাপী,মার্জিত ব্যবহারের অধিকারী তথা আপাদমস্তক শিষ্ঠাচারাবৃত একজন সাদা মনের মানুষ।ব্যক্তিস্বার্থে তাঁর লালিত ইসলামের মূলধারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আদর্শ থেকে কষ্মিনকালেও তিনি বিচ্যুত হন নি।কোন রাজনৈতিক দলের সাথে আল্লামা জালাল উদ্দীন আল ক্বাদেরীর পত্যক্ষ সম্পৃক্ততা দৃশ্যমান হয় না।তিনি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ,নির্দলীয় ও অবিতর্কিত একজন নন্দিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে সমধিক পরিচিত ছিলেন। ইসলামের সঠিক রুপরেখা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মানব জীবনের একমাত্র সঠিক পথ ও মত হিসেবে তাঁর নিকট অধিকতর বিবেচ্য ছিল।ফলে ইসলামের বিশুদ্ধ আকিদা সুন্নীয়তের উপর আমৃত্যু অনড় ও অবিচল থেকে তিনি নিরলসভাবে দ্বীনি খেদমতে আন্জাম দিয়ে গেছেন।সমাজে প্রকৃত ইসলামী তাহজীব- তামাদ্দুন প্রতিষ্ঠাই বরাবরই বাতিল অপশক্তির সর্বপ্রকার অপকৌশল, চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তিনি ব্যাঘ্র ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের দেশ প্রেমিক ব্যক্তিত্ব।যৎকারণে বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ ও অন্যতম অর্জন মহান স্বাধীনতার বিরোধী যে কোন কর্মকান্ড ও অপতৎপরতার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার কন্ঠ।সত্য কথার বলিষ্ঠ উচ্চারণ এর মত কালজয়ী প্রবাদ যার চরিত্রে প্রতিবিম্বিত হতো বলেই তিনি একাধিকবার বাতিল অপশক্তির অবাঞ্চিত আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন।কারও কোন প্রকার অবাঞ্চিত চোখ রাঙ্গানী ও অশুভ প্রভাব তাঁকে তাঁর অবস্হান থেকে চুল পরিমাণও টলাতে পারে নি।আল্লামা জালাল উদ্দীন আল ক্বাদেরী যে একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব,তার ইন্তেকাল পরবর্তী প্রেক্ষাপটে ও তা সন্দেহাতীতভাবে তা প্রমাণিত হয়েছে। বিগত ২৬ নভেম্বর ১৬ সালে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মোজাদ্দিদ আল হযরত ইমামে আহমদ রেযা রহম এর ৯৮ তম ওফাত বার্ষিকী উপলক্ষে রাজধানী ঢাকার বি এম এ অডিটোরিয়ামে আয়োজিত আলা হযরত কনফারেন্স এ সভাপতি হিসেবে আমন্ত্রিত হন।যথারীতি অনুষ্ঠানে উপস্হিত হয়ে সভাপতির গুরু দায়িত্ব পালন করেন।বিকাল ৩ টার দিকে হঠাৎ তিনি অসুস্হ বোধ করেন।তাৎক্ষণিক তাকে নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে।কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে সুস্হ করতে প্রাণপন চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।রাত ঠিক ১০:১৩ মিনিটের সময় ইহজগতের মায়া ত্যাগ করে পরজগতে পাড়ি জমালেন। এ কথা অনস্বীকার্য যে, তিনি চট্রলা মায়ের অগ্নিগর্ভা সন্তান হিসেবে চট্রগ্রামে স্হায়ী ভাবে বসবাস করতেন।উপরন্তু তাঁর পেশাগত ক্ষেত্রটি ও ছিল চট্রগ্রামে।তিনি যদি চট্রগ্রামে ইন্তেকাল করতেন,কষ্মিনকালেও তাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হতো না, এবং নিয়ে যাওয়ার ও কথা নয়।স্রষ্টার কি অপার মহিমা! কাকতালীয় ভাবে তিনি ইন্তেকাল করলেন ঢাকায় এবং পরদিন রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুরস্হ মাদ্রাসায়ে কাদেরীয়া তৈয়্যবিয়া তে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।এ জানাজায় ও হাজার হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করে।একই দিবসে ঢাকা বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ প্রাঙ্গনে ও তার নামাযে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত জানাজায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীপরিষদ, সংসদ-সদস্য,সরকারী – বেসরকারি সেক্টরের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ,পীর- মাশায়েখ,ওলামায়ে কেরাম সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ উপস্হিত ছিলেন।যা দেশের সকল ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া ও সংবাদপত্রের মধ্যে ফলাও করে প্রচার করা হয়।পরদিন ২৮ নভেম্বর ১৬ ইং চট্রগ্রাম জমিয়তুল ফালাহ ময়দানে বাদে যোহর তৃতীয় জানাজা এবং বাদে আসর জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার মাদ্রাসা ময়দানে চতুর্থ জানাযার নামাযের সময় নির্ধারিত হয়।বাদে যোহর জানাজার নামায প্রচারিত হলেও ১২ টার দিকে জমিয়তুল ফালাহর ময়দান লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়।জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ভক্ত অনুরক্ত গণ বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মত দলে দলে আসতে শুরু করে।পুরো জমিয়তুল ফালাহ ময়দান টইটুম্বুর।কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না।উপায়ন্তর না দেখে আগত মুসল্লিরা পাশ্ববর্তী রাস্তা সমূহ তথা এদিকে কাজীর দেউড়ী এবং অপরদিকে দামপাড়া পর্যন্ত রাস্তার উপর জানাযার নামায আদায় করেন। চারিদিকে মানুষ আর মানুষ ছাড়া আর কিছুই দৃশ্যমান ছিল না।অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, যতগুলো মুসল্লি জানাযায় অংশগ্রহণ করেছিল, তাঁর চেয়ে দ্বিগুণ মানুষ জানাযায় অংশগ্রহণ করতে না পেরে ব্যর্থ মনোরথে ফিরে যায়।যৎকারণে ঐ দিন চট্রগ্রাম শহরে দীর্ঘ সময় ধরে রাস্তায় জানযট সৃষ্টি হয়।জানযট এড়াতে হিমশিম খেতে হয় প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের। আনুমানিক ৩ কিলোমিটার দুরত্বে ৪র্থ জানাযাটি অনুষ্ঠিত হয় ষোলশহরস্ত জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার মাদ্রাসার ময়দানে।ঐ জানাযায় ও নেমে আসে জনস্রোত। ২ টার পর থেকে মুরাদপুর হতে হাটহাজারী রোডের প্রবেশ পথ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। কি অভূতপূর্ব এক দৃশ্য!মুরাদপুর থেকে শুরু করে জামেয়ার ময়দান এবং আশপাশস্হ এলাকা অর্থ্যাৎ নাজিরপাড়া খতিবেরহাট হয়ে বহদ্দারহাট পর্যন্ত দেখা গেছে এক মহাজনসমুদ্র।শুধু মানুষ আর মানুষ। জানাযায় এ ধরণের উপস্হিতি ও লোকসমাগম তাঁর প্রতি সর্বস্তরের মানুষের গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ নিঃসন্দেহে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়,- আল্লামা জালাল উদ্দীন আল ক্বাদেরী রহঃ জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া ও জমিয়তুল ফালাহর যে দায়িত্ব পালন করেছেন,ঠিক তদ্রুপভাবে তিনি ঢাকা বায়তুুল মোকাররম মসজিদ এবং কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া মাদ্রাসার যথাক্রমে অধ্যক্ষ ও খতিবের দায়িত্ব খন্ডখালিন পালন করেছেন।স্রষ্টার লীলা বুঝার সাধ্য কার! তাঁরই স্মৃতি বিজড়িত ৪ টি প্রতিষ্ঠানেই তার বিশাল ৪টি জানাযা অনুষ্ঠিত হয়।আল্লামা জালাল আল ক্বাদেরী রহঃ কেবল ইসলামী শরিয়তের দায়িত্ব পালন করেই ক্ষান্ত হন নি।তরিক্বতের দায়িত্বও তিনি নিষ্ঠার সাথে পালন করেছেন।সিলসিলায়ে আলিয়া কাদেরিয়া তরিকতের আমৃত্যু একনিষ্ঠ একজন উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন সেবক ছিলেন তিনি।ছাত্রজীবনেই উপমহাদেশের প্রখ্যাত অলীয়ে কামেল মোর্শেদে বরহক হযরতুলহাজ্ব আল্লামা হাফেজ ক্বারী সাইয়্যিদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ রহঃ এর হাতে বাইয়্যাত গ্রহণ করতঃতাঁর রুহানী সন্তান হিসেবে তরিক্বতের কাজ আন্জাম দিতে তিনি বিশ্বের দেশে-দেশে সফর করেছেন।বাংলাদেশ সহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে হুজুরের সাথে
বিভিন্ন ইসলামী কনফারেন্স, সুন্নী সম্মেলন, সেমিনার তথা তরিক্বত সংশ্লিষ্ট কাজে অংশগ্রহণের আমারও সৌভাগ্য নসিব হয়।আল্লামা জালাল উদ্দীন আল ক্বাদেরী রহঃ অসাধারণ দক্ষতা ও দূরদর্শিতা দিয়ে একজন কালোত্তীর্ণ মানুষ হিসেবে আজ সু প্রতিষ্ঠিত।তিনি শুধু একজন আলেম কিংবা শিক্ষাবিদই নন,বরং তিনি একটি প্রতিষ্ঠান।এ ছাড়াও তিনি একজন কর্মমূখর,সৃষ্টিশীল ও বিরল প্রতিভার অধিকারী মহান ব্যক্তিত্ব।আল্লামা জালাল উদ্দীন আল ক্বাদেরী রহঃ দেশের একজন প্রথিতযশা আলেমেদ্বীন ও প্রখ্যাত ইসলামী স্কলার হিসেবে শুধু দেশে নয়,আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ও সুখ্যাতি পেয়েছেন।যাঁর জ্ঞান গর্ভ শ্রুতিমধুর বক্তব্য, দুরদৃষ্টিসম্পন্ন আলোচনা মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধের মত মানুষকে আকৃষ্ট করত।শুধু তাই নয়,একজন বাকপটু,বাগ্নী ও অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী মানুষ হিসেবেও তাঁর জুড়ি মেলা ভার।ইসলামী জ্ঞান – বিজ্ঞানের অধিকতর চর্চা ও গবেষণার মাধ্যমে তিনি ইসলামী শরিয়ার একজন প্রাজ্ঞ ও বিদগ্ধ ইসলামী স্কলার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান।তাঁর সুললিত কন্ঠে উচ্চারিত সত্য, ন্যায় ও শান্তির আহ্বানে অসংখ্য দিকভ্রান্ত মুক্তিপাগল মানুষ পেয়েছেন সঠিক পথের সন্ধান।তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশ- বিদেশের অগণিত মানুষ জাতীয় জীবনে একটি সুস্হ সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আত্ননিয়োগ করে।মাযহাব- মিল্লাতের যেকোনো সংকটাপন্ন মূহুর্তে যে মানুষটির সাহসী ও বলিষ্ট ভূমিকা ছিল অনবদ্য,যার বুদ্ধিদীপ্ত, কুশলী চিন্তা-চেতনা দিয়ে যুগ জিজ্ঞাসার কার্যকর সমাধানে দেশ ও জাতি সঠিক পথের দিশা পেতে তাঁর চিরবিদায় স্বভাবতই বিরহের,দুঃখের,বিষাদের ও বেদনার।আল্লামা জালাল উদ্দীন আল ক্বাদেরী পল্লী গ্রামে জম্মগ্রহণ করলেও নিজেকে গ্রামীণ পরিমন্ডলে আবদ্ধ রাখেন নি।তাঁর মেধা,যোগ্যতা,ধর্মপরায়নতা, সাহসিকতা সর্বোপরি সীমাহীন দেশপ্রেমের কারণে তিনি মর্যাদার শীর্ষ আসনে সমাসীন হয়েছেন।তিনি মাযহাব,মিল্লাত ও জনকল্যাণে আত্ননিয়োগ করে জাতীয় জীবনে নিজেকে একজন Great Pioneer of Islam” হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন।সমাজে বিদ্যমান অনিয়ম, অসংগতি,দুর্নীতি, অত্যাচার,অবিচার,সহ সর্বপ্রকার গর্হিত কর্মকান্ডের মূলেৎপাটন করে জাতীয় জীবনে তিনি একটি নিরুপদ্রব ও নিষ্কন্টক সমাজ বির্নিমানের মহান স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে নিরলস সংগ্রাম করে গেছেন।জাতীয় জীবনে ইসলামী গণজাগরণ সৃষ্টিতে তাঁর বহুমাত্রিক প্রয়াস, প্রচেষ্টা,পদক্ষেপ, ও উদ্যোগ আয়োজন সত্যিকার অর্থে মাইলস্টোন হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকবে।পবিত্র কোরআন- সুন্নাহর খন্ডিত উপস্হাপন তথা বিকৃতচর্চার মাধ্যমে মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাতিল অপশক্তির সর্বপ্রকার অশুভ পায়তারার বিরুদ্ধে আল্লামা জালাল উদ্দীন আল ক্বাদেরী ছিলেন সর্বদা সোচ্চার কন্ঠ। ইসলামের নামে অভিশপ্ত জঙ্গিবাদ,ওহাবীবাদ,মওদুদীবাদ,সালাফী,রাফেজী,খারেজী,শিয়া,কাদিয়ানী মতবাদীদের মুখোশ উম্মোচনে তিনি কখনো পিছ পা হন নি।এদেশের মহান স্বাধীনতার চেতনা ও মূল্যবোধ সুরক্ষায় দেশদ্রোহী,রাজাকার,আলবদর,আল শামস,ও সকল অগণতান্ত্রিক অপশক্তির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও তিনি অনন্য অসাধারণ অবদান রেখেছেন। আল্লামা জালাল উদ্দীন আল ক্বাদেরী রহঃ এর মত একজন বরেণ্য ও বিদগ্ধ ব্যক্তিত্বের প্রয়াণে জাতীয় জীবনে সৃষ্ট শুন্যতা কখনও পূরণ হবার নয়।তিনি আজীবন বেচে থাকবেন তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মযজ্ঞ ও তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শের মাঝে।আজীবন স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবেন লক্ষ-লক্ষ ছাত্র সহ অসংখ্য ভক্তকুলের মাঝে।তিনি কখনো ও হারিয়ে যাবেন না কালগর্ভে।আল্লাহ তাঁকে জান্নাতের উচ্চাসন নসীব করুন।আমিন,বেহুরমতি সাইয়্যিদিল মুরছালিন।

~~~ ২০১৭ সালের পবিত্র দরসুল কুরান মাহফিল উপলক্ষ্যে প্রকাশিত স্মরণিকা থেকে সংগৃহীত

[related_post themes="flat" id="819"]