বাংলাদেশে ইলমে দ্বীন প্রসারে অন্যতম নীরব সাধক আল্লামা নিয়াজ মাখদুম খোত্তানী (রঃ)
বাংলাদেশে ইলমে দ্বীন প্রসারে অন্যতম নীরব সাধক, হাজার হাজার ওলামা মাশাইখ গড়ার কারিগর আল্লামা নিয়াজ মাখদুম খোত্তানী (রঃ)। যিনি এদেশে ইলম চর্চার জন্য নিজ জন্মভূমি সুদূর রুশীয় তুর্কিস্থানের খোতান থেকে এই সবুজ বাংলায় হিজরত করেছিলেন।
আল্লামা নিয়াজ মাখদুম খোতানী (রহ.) ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে রুশীয় তুর্কিস্থানের খোতান প্রদেশের সম্ভ্রান্ত এক আলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বিশ শতকের গোড়ার দিকে উক্ত অঞ্চলে কমিউনিস্টবিরোধী আন্দোলনের প্রধান সেনাপতি আল্লামা নিয়াজ মাখদুম খোতানী (রহ.) অলৌকিকভাবে প্রাণে রক্ষা পেয়ে ভারতবর্ষে হিজরত করেন।
সামরিক বাহিনীতে ও জিহাদের ময়দানে আল্লামা খোতানী হুজুর (রঃ) :
রুশীয় বলশেভিক বিপ্লবের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে চীনারা তুর্কীদের ওপর যখন চড়াও হয়, আল্লামা নিয়ায মাখদূম খোতানী (র.) তখন কাশগড়ে অধ্যয়নরত। এ অবস্থায় তিনি স্বদেশের স্বাধীনতা এবং শাশ্বতধর্ম ইসলামের স্বকীয়তা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য সামরিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করলেন। তাই তিনি ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে দেশীয় সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। অল্পদিনের মধ্যে স্বীয় দক্ষতা ও নৈপূণ্যের বলে একটি বাহিনীর সেনাপতি হন। আল্লামা খোতানী হুজুর যে অঞ্চলের সেনাপতি ছিলেন, সে অঞ্চলে একদিন কমিউনিস্ট বর্গীরা আক্রমণ করল। লড়াই চলল মাসের পর মাস। কয়েকটা লড়াইতে বিজয়ী হয়ে তাঁরা অবস্থান করছিলেন প্রধান দুর্গে। এ সময় তিনি বাড়ি থেকে খবর পেলেন তার একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়েছে। এটিই প্রথম সন্তান। স্ত্রী ও সন্তানের মুখ দেখার জন্য তিনি ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। ছুটি নিলেন কিছু দিনের। ইত্যবসরে এল মারাত্মক দুঃসংবাদ। কমিউনিস্ট বাহিনী পঙ্গপালের মতো ধেয়ে আসছে। পথের জনপদে আগুন জ্বালিয়ে ছারখার করছে। তারা কাছেই এসে পড়েছে। লক্ষ্য তাদের এই দুর্গ। ছুটি বাতিল হলো। সাহায্যের আবেদন পাঠানো হলো বিভিন্ন স্থানে। প্রস্তুত হলেন মোকাবেলার জন্য। কমিউনিস্ট বাহিনী এসে অবরোধ করল দুর্গ। দীর্ঘ একমাস পর্যন্ত চলল অবরোধ। এর মধ্যে সাহায্য এলো না। এদিকে খন্ড খন্ড যুদ্ধে রসদও প্রায় শেষ। ইতোমধ্যে কমিউনিস্ট সৈন্যরা দুর্গের বহির্দেয়াল ধসিয়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। শিলাঝড়ের মতো বুলেটের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ধসে পড়েছে দুর্গের সব দেয়াল। বুলেট বিদ্ধ হয়ে একে একে শাহাদাতের অমৃত সুধা পান করছেন সাথী মুজাহিদগণ। মাথার ওপর দিয়ে, কাঁধের পাশ দিয়ে অগণিত বুলেট চলে যাচ্ছে। শত্রু এগিয়ে আসছে, আর সময় নেই। প্রচন্ড গোলাগুলির মধ্যে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর ভরসা করে ঝাঁপ দিলেন নিচে। দেখে ফেলেছে দুশমন। গুলি চালাচ্ছে তাঁরই দিকে তাক করে। তবুও আল্লাহর বিশেষ মেহেরবাণীতে বেঁচে গেলেন আল্লামা নিয়ায মাখদূম খোতানী (র.)।।
স্বদেশ ভূমি পুনরুদ্ধারের সংকল্পঃ
বীর সেনানী আল্লামা নিয়ায মাখদূম খোতানী (র.) সাথী মুজাহিদদের হারিয়ে শত্রু বাহিনীর তীব্র আক্রমণের মাঝেও ছুটলেন সামনের দিকে। সামনে পেলেন জীন পরিহিত সম্পূর্ণ প্রস্তুত একটি ঘোড়া। তার পিঠে আরোহণ করে চলছেন তো চলছেন। আর পিছে তাকাবার সময় নাই। পেছনে শত্রু বাহিনীও ধাওয়া করছে। অগণিত গুলি ছুঁড়ছে আল্লামা খোতানী হুজুরের দিকে। কিন্তু আল্লাহ যাকে হিফাজত করেন কার সাধ্য তার ক্ষতি করার। কয়েকদিন পাহাড়-পর্বত ঘেরা অঞ্চলের মধ্য দিয়ে চলছেন। শত্রু বাহিনীও পেছনে পেছনে আসছে। অবশেষে একটি নদীর তীরে এসে পৌঁছলেন। অতি কষ্টের কারণে দুঃসময়ের একমাত্র সম্বল ঘোড়াটি মারা যায় সেখানেই। ঝাঁপ দিলেন নদীতে। দীর্ঘক্ষণ সাঁতার কাটার পর পৌঁছলেন অপর তীরে। শত্রুবাহিনী সেখান থেকে তাদের গতি রোধ করলে একটু নিরাপদ ভাবলেন তিনি নিজেকে। নদীর অপর তীরের সেই এলাকাটির নাম যদিও আমরা সংগ্রহ করতে আজও পারিনি তবুও সে স্থানটি যে চীনের একটি অঞ্চল ছিল তা নিশ্চিত। ওই অঞ্চলটি তখনো কমিউনিস্টদের অধীনে আসেনি। আল্লামা খোতানী হুজুর তখন মনে মনে দৃঢ় সংকল্প নিলেন, যেভাবেই হোক স্বদেশকে উদ্ধার করতে হবে আল্লাহদ্রোহীদের হাত থেকে। এজন্য প্রয়োজন শক্তিশালী সামরিক বাহিনী। তিনি স্থির করলেন সামরিক বাহিনীতে ভর্তি হবেন। প্রয়োজনে জার্মান, ইংল্যান্ডে গিয়ে উন্নততর সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবেন। তাই এ অঞ্চলের সামরিক বাহিনীতে যোগ দিলেন। কিন্তু ঐ অঞ্চলটি যদিও কমিউনিস্ট শাসনের আওতায় ছিল না তবুও কমিউনিজমের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল ঐ অঞ্চলের শাসকগণ। অসংখ্য ইসলামবিরোধী কুপ্রথার অনুসারী ছিল তারা। এমনকি যখন জাতীয় সংগীত বাজানো হতো তখন রাষ্ট্রপ্রধানের ছবি সামনে পেশ করা হতো। আর সৈন্যদেরকে সেই প্রতিকৃতিতে কখনো-বা স্বয়ং রাষ্ট্রপ্রধানকে মাথানত করে কুর্ণিশ করতে হতো। আল্লামা খোতানী হুজুর (র.) ছিলেন ইসলামী আদর্শের পূর্ণ অনুসারী। তিনি সাথে সাথে তীব্র ভাষায় এর প্রতিবাদ জানালেন। ঈমানী অগ্নিশিখায় প্রজ্বলিত আল্লামা খোতানী হুজুর (র.) দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, ‘এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও সামনে মাথা নত করা যায় না’। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলো, ‘এদেশে আলেম সমাজ এ প্রথার অনুমোদন দিয়েছে’। আল্লামা খোতানী হুজুর (র.) বললেন, ‘কোন আলেম ইসলামের দলীল নয়। কোরআন, সুন্নাহ-ই ইসলামের দলীল। কোরআন, সুন্নাহর যতটুকু জ্ঞান আমার আছে তাতে আমি দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করছি, এটা ইসলাম গর্হিত কাজ’। যদিও আল্লামা খোতানী হুজুরের প্রতিবাদ ছিল সুস্পষ্ট, কিন্তু প্রতিবাদী ছিলেন তিনি একা। সরকারের সাথে কোন প্রকারে একমত হতে না পেরে নিজের ঈমান, ইসলামী আদর্শকে বড় মনে করে বাধ্য হয়ে তিনি ঐ সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন।।
বাংলাদেশে আল্লামা খোতানী হুজুর (র.):
_____________________________
ব্রিটিশ ভারতের আইনের বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের সহায়তায় বরিশালের ছারছীনা মাদরাসায় যখন টাইটেল খোলার উদ্যোগ নেয়া হয়, তখন উচ্চশিক্ষিত মুহাদ্দিসের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে ছারছীনা শরীফের মরহুম পীর শাহ সূফী নেছারুদ্দীন আহমদ (র.) খোতানী হুজুরকে আনার জন্য পত্র লেখেন। এদিকে তৎকালীন কলকাতা আলিয়া মাদরাসার অধ্যাপক আল্লামা আব্দুর রহমান কাশগরী (র.) ছিলেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং আল্লামা খোতানী হুজুরের একান্ত আপনজন। শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের অনুরোধক্রমে আল্লামা কাশগরী (র.) ও আল্লামা খোতানী হুজুরকে উৎসাহিত করলেন ছারছীনাতে আসার জন্য। এদিকে মরহুম নেছার উদ্দীন (র.)-এর পত্র পেয়ে ভারতীয় সকল আসাতিযায়ে কেরাম সুপরামর্শ দিয়ে আল্লামা খোতানী হুজুরকে ছারছীনাতে পাঠালেন। ছারছীনা সেদিন ছিল অনুন্নত ও অস্বাস্থ্যকর একটি পল্লীমাত্র। তবুও ইলমে হাদীসের খেদমতের মহান উদ্দেশ্যে খোতানের সেনাপতি জ্ঞানের সম্পদ নিয়ে বাংলার নিভৃত পল্লী নারিকেল বীথিবেষ্টিত ছারছীনায় ১৯৪৫ সালে প্রধান মুহাদ্দিস পদে যোগদান করেন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত মোট ৪০ বছর ছিলেন তিনি সেই পদেই অধিষ্ঠিত। প্রায় অর্ধ শতাব্দী পর্যন্ত উপমহাদেশে ছারছীনা মাদরাসার অধিকতর সুখ্যাতির অন্যতম কারণ ছিল আল্লামা খোতানী হুজুর (র.)। তিনি কত ব্যাপক জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন তা তাঁর সাহচর্য প্রাপ্তদের ছাড়া অন্যদের পক্ষে বুঝা দুরূহ ব্যাপার।।
একবার বাইশ ভাষার এক পন্ডিত আল্লামা খোতানী হুজুরের সাথে কোনো এক বিষয়ে বিতর্কে হেরে গিয়ে অবশেষে তাঁকে ‘বাহরুল উলূম’ আখ্যা দিতে বাধ্য হয়ে ছিলেন। তাঁর দরস বা পাঠদানের পদ্ধতি ছিল অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। সহজ-সরল উপস্থাপনা, সারগর্ভ বক্তব্য, সাইন্স, ফিলোসফি, বায়োলজি, এস্ট্রোলজি এক কথায় বিজ্ঞান ও দর্শনে তাঁর তাকরীর ছিল পরিপূর্ণ। তাঁর পাঠদান এতই রূহানিয়াতপূর্ণ ছিল যে, একবার মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করলে আর তা পড়তে হতো না। অসংখ্য প্রমাণ আছে যে, আল্লামা খোতানী হুজুরের দরসে বসার বরকতে অনেক ছাত্রের স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতবড় জ্ঞানের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন নিরহংকার, সহজ-সরল জীবনের অধিকারী, রিয়া বা লৌকিকতার ঊর্ধ্বে। সাধারণ একজন মানুষের প্রতি তার হৃদ্যতা, স্নেহ বা শ্রদ্ধা ছিল বিস্ময়কর। বিনয়, নম্রতা, উদারতা, সরলতা ছিল তার চরিত্রের অন্যতম ভূষণ। মানুষের হক বিশেষ করে ছাত্রদের হকের ব্যাপারে তিনি ছিলেন খুবই সজাগ। আল্লামা খোতানী হুজুর (র.) আতিথেয়তায় ছিলেন অনন্য। প্রতিটি ছাত্রকে তিনি মনে করতেন নিজ ছেলে হিসেবে। ছাত্রদের দুঃখ-বেদনায় তাঁর হৃদয় কেঁদে উঠত। তাঁর ৪০ বছর অধ্যাপনাকালে হাজার হাজার ছাত্র, দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদগণের প্রত্যেকের হৃদয়ে আল্লামা খোতানী হুজুর (র.) তার চরিত্র মাধুর্যের কারণে বিশেষ স্থান দখল করে আসছে। আল্লামা খোতানী হুজুর (র.) কখনো কোনো অহেতুক আলোচনায় সময় নষ্ট করতেন না। কিতাব মোতালায়া ছিল তাঁর অন্যতম নেশা। রাতভর তিনি কিতাব মোতালায়া করতেন। নামাযের বৈঠকের ন্যায় ছাড়া তাঁকে কেউ কোনো দিন দরসে বসতে দেখেছে কিনা জানা নেই।
আল্লামা খোতানী হুজুর (র.) ছিলেন যুগ শ্রেষ্ঠ অলী।প্রথম জীবনে দেওবন্দে তিনি মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী এর হাতে বাইআত হন। পরে দেওবনদী আকিদার ভুল বুঝতে পেরে ছারছীনাতে মরহুম নেছারউদ্দিন (র.)-এর হাতে “তাজদীদে বাইআত” গ্রহণ করেন। শরিয়তের আহকামের প্রতি তিনি ছিলেন অত্যন্ত মনোযোগী। ফরজ, ওয়াজিব তো দূরের কথা প্রতিটি সুন্নাত-মুস্তাহাবের আমলে তিনি ছিলেন অভ্যস্ত। তাকওয়া-পরহেজগারীতে তিনি ছিলেন অত্যন্ত উচ্চাঙ্গ মানের।
তিনি নিজের মাতৃভূমি থেকে হিজরত করে এই সবুজ দেশটাকে ভালোবেসেছিলেন। এমনকি আমৃত্য এদেশেই ছিলেন। দীর্ঘদিন ইলমে হাদীসের খিদমত শেষে অসংখ্য ভক্ত-অনুরক্ত রেখে ১৯৮৬ সালের ২৯ অক্টোবর বুধবার বিকেলে তিনি ইন্তেকাল করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। ঢাকার আজিমপুর নতুন গোরস্তানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। আজো সেখানে আল্লামা খোতানী হুজুরের মাযারে সর্বদা তাঁর ভক্তদের ভিড় জমে।।
লেখকঃ শাহীদ রিজভী, অর্থ সম্পাদক, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ